২৩ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩১

এক বছরের মাথায় আবারো গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ

আপাতত আবাসিক খাতে দাম বাড়ছে না** বিদ্যুত্ কেন্দ্র ও সার কারখানায় চারগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব ** জ্বালানি খাতে দুর্নীতি বন্ধ হলে দাম বাড়ানোর দরকার নেই :ক্যাব


গ্যাসের দামবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর এক বছরের মাথায় ফের নিত্যদিনের জ্বালানি পণ্যটির দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলো। তবে এবার আপাতত আবাসিক খাতে দাম বাড়ছে না। শিল্প, বাণিজ্যসহ সব খাতে গড়ে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এলএনজি আমদানির ফলে গ্যাসের গড় দাম বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য পুনঃনির্ধারণের এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা।

গ্যাস বিতরণকারী পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে ইতোমধ্যে তিতাস এবং বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পাঠিয়েছে। অন্য তিনটি কোম্পানি কয়েকদিনের মধ্যেই প্রস্তাব জমা দিবে।

জানা যায়, প্রস্তাবনায় বিদ্যুত্ কেন্দ্র ও সার কারখানায় তিন থেকে চারগুণ দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, শিল্প খাতে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত দর বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া গ্যাস সঞ্চালন মাসুল বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (জিটিসিএল)।

আগামী এপ্রিল-মে থেকে জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) যুক্ত হবে। দেশীয় গ্যাসের চেয়ে এলএনজির দাম বেশি বলে লোকসান কমাতে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলেছেন, গত বছরের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ধকল এখনো তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এরপর এখন গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে শিল্প-কারখানা টিকতে পারবে না। তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন। কারণ শিল্পপণ্যের উত্পাদন ব্যয় আরও বাড়বে। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর। তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান জানান, তারা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠিয়েছেন। এলএনজি আসার পর গ্যাসের যে মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে তা পর্যায়ক্রমে সমন্বয়ের জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপাতত আবাসিকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে না।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়। মার্চ থেকে তা কার্যকর হয়। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য সাত টাকা ৩৫ পয়সা।

বিইআরসির এক সদস্য বলেন, কমিশন সব কোম্পানির প্রস্তাব পাওয়ার পর একটি কমিটি গঠন করে প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে গণশুনানির আয়োজন করবে। এরপর তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। বাস্তবতা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, নির্বাচনের বছরে গ্যাসের দামবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্পে বাড়লে নির্বাচনে এর প্রভাব কম। তাই আপাতত আবাসিক খাতে দাম বাড়বে না। তবে নির্বাচনের পর এ খাতেও দাম বাড়াতে হবে। এক পর্যায়ে বাসাবাড়িতে গ্যাসের পরিবর্তে এলপিজি সরবরাহ করতেই বেশি আগ্রহী সরকার।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এসএম শামসুল আলম বলেন, এক বছরের মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত হবে না। জ্বালানি খাতে যে দুর্নীতি হয় ও অপচয় হয় তা বন্ধ হলে এলএনজির জন্য কোম্পানিগুলোর আয়ই যথেষ্ট হবে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

জানা যায়, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে ৩ টাকা ১৬ পয়সা। এই খাতে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি ইউনিট ১০ টাকা। এই খাতে উত্পাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। এছাড়া সার কারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম দিতে হয় ২ টাকা ৭১ পয়সা। এক্ষেত্রে নতুন প্রস্তাব করা হয়েছে ১২.৮০ টাকা। উত্পাদিত মোট গ্যাসের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহূত হয় সার কারখানায়। আর শিল্প-কলকারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ গড়ে ৭.৭৬ টাকা। এ শ্রেণিতে ১০০ শতাংশের মতো বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই হিসাবে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১৫ টাকা। শিল্পে মোট উত্পাদিত গ্যাসের ২০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহূত হচ্ছে।

অপরদিকে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস সিএনজিতে আগে দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৪০ টাকা। নতুন করে এই খাতে দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৮ টাকা। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ারে আগে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৯.৬২ টাকা। নতুন প্রস্তাবে দাম বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ টাকা। চা বাগানের আগে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৭.৪২ টাকা। নতুন প্রস্তাবে দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২.৮০ টাকা।

এছাড়া বাণিজ্যিকে ১৭ টাকা ৪০ পয়সা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আর আবাসিক সংযোগে এক চুলার জন্য মাসে ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। এ খাতগুলোতে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। আবাসিকে ১৫ শতাংশ ব্যবহূত হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, আগামী মে মাস থেকে দিনে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা এলএনজি থেকে পাওয়া যাবে। এ বছরের শেষে তা ১০০ কোটি ঘনফুট এ উন্নীত হবে। এ খাতে সরকারকে বছরে পর্যায়ক্রমে আট থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এর মধ্যে সাত হাজার কোটি টাকা জোগান হবে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে। বাকি টাকার জোগান দিতে সরকার আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।

http://www.ittefaq.com.bd/trade/2018/03/22/151391.html