২৩ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩০

মশা নিধনের গোড়ায় গলদ

মশার ডিম, লার্ভা ও পিউপা বাদ রেখে শুধু বড় মশা মারলে কোনো কাজ হবে না

কামান দাগিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে, তরল ছিটিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে, স্প্রে মেরে, গাপ্পি মাছ ছেড়ে—কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না মশা। বরং দিনে-রাতে ঘরে-বাইরে আরো বেশি অপ্রতিরোধ্য ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে মশা। মশাবিরোধী যুদ্ধে হেরে গিয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রোগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার কাছে এই পরাজয়ের নেপথ্যে রয়েছে মশা নিধন কার্যক্রমের গোড়ায় গলদ।

মশা এ দেশে কেন এত অপ্রতিরোধ্য হয়েছে উঠেছে—এমন প্রশ্নে প্রবীণ কীটতত্ত্ববিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহাবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বড় মশা যেহেতু মানুষকে কামড়ায়, তাই মানুষও বড় মশা মারতেই বেশি তৎপর থাকে। কিন্তু মশা নিধনের গোড়ায়ই তো বড় গলদ থেকে যাচ্ছে। গোড়ায় গলদ রেখে ওপরে কীটনাশক ছিটালে কি কার্যকর ফল পাওয়া যাবে! এ ছাড়া মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও তো প্রশ্ন রয়েছে। সেখানেও নানা গলদ থাকে। মশার ওষুধ নিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য জড়িত। এই বাণিজ্যের ভেতরেও নকল-ভেজাল বা অকার্যকর কীটনাশকের দৌরাত্ম্য থাকে। ফলে টাকা যায়, ওষুধ যায়; কিন্তু মশা যায় না, মানুষও স্বস্তি পায় না!

সবচেয়ে বড় গলদ কী জানতে চাইলে ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মশার জীবনচক্র নিয়ে আমাদের দেশে এখনো ভালোভাবে চর্চা হচ্ছে না। যাঁরা মশা নিয়ন্ত্রনে কাজ করছেন তাঁরাও বিষয়টিকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা বুঝতে পারেন না। মশার জীবনচক্রে যে চারটি ধাপ রয়েছে এর মধ্যে তিনটি—ডিম, লার্ভা ও পিউপা ধাপই মশা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর সময়। মশা ডিম পাড়ে পানির কাছাকাছি কোনো শুকনো স্থানে বা পানির ওপরে ভাসমান শুকনো কোনো কিছুর ওপরে। আর তা যখনই কোনো না কোনোভাবে পানির সংস্পর্শে আসে তখনই ফুটে লার্ভায় পরিণত হয়। ওই লার্ভা আরেক ধাপ এগিয়ে পানির ভেতরই পিউপায় পরিণত হয়। পিউপা থেকেই রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ মশায়। এর মধ্যে পুরুষ মশা খাদ্য নেয় গাছপালা, লতাপাতা জাতীয় নরম অংশের কার্বোহাইড্রেট থেকে। আর নারী মশা নিজের জন্য না হলেও সন্তানের জন্য মানুষ বা অন্য প্রাণীর রক্ত খুঁজে বেড়ায়। এই উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে উড়ন্ত পূর্ণবয়স্ক মশা মারার জন্যই সবচেয়ে বেশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু গোড়ায় যে পানিতে ডিম, লার্ভা ও পিউপা—তিনটি ধাপে দ্রুত বেড়ে উঠছে সেদিকে খেয়াল কমই রাখা হচ্ছে। আর তাপমাত্রা এই তিনটি স্তরকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করে থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আবহাওয়া মশার এই প্রজননচক্রের জন্য খুবই আদর্শ এক পরিবেশ হয়ে উঠেছে।
কেবল ওই কীটতত্ত্ববিদই নন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও নিপসমের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদও বেশ শক্ত করে বলেন, ‘গোড়ায় তো গলদ আরো আছে। লার্ভিসাইডে (লার্ভানাশক) যেমন জোর দেওয়া হচ্ছে কম, তেমনি যে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে তার কার্যকারিতাও তো আমরা খতিয়ে দেখছি না ভালোভাবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সরকারি-বেসরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু তা কাজে আসছে না—এটা তো খুবই বিপদের কথা। এ ক্ষেত্রেই অন্য সব ওষুধের মতো এই কীটনাশকেরও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে যে মশার মধ্যে কীটনাশক প্রতিরোধী সক্ষমতা তৈরি হয়নি, সেটা কি আমরা জোর দিয়ে বলতে পারছি! বরং এটাই জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে যে এসব কীটনাশকের কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাচ্ছে আর মশার প্রজনন উপযোগী মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশের উন্নতি ঘটেছে। ফলে মশা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কিছুটা প্রভাবও রয়েছে। কারণ তাপমাত্রার ওপর মশার প্রজনন অনেকটাই নির্ভর করে থাকে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সম্মিলিত মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডিম, লার্ভা, পিউপা নিধনে লার্ভিসাইড, বড় মশা নিধনে অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগ করতে হবে, পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়ও অনেক বেশি নজর দিতে হবে। জলাশয়-নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে এবং পানিপ্রবাহ বাড়াতে হবে। পারিবারিকভাবে ঘরে ঘরে মশার প্রজনন যাতে না হতে পারে সে জন্য সচেতন থাকতে হবে।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এক তথ্য দিয়ে বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সার্ভে করে দেখেছি, একজন মানুষ যদি সেখানে এক ঘণ্টা অনড় বসে থাকে তবে তাঁকে প্রায় ৪০০টি মশায় কামড় দেয়। এটা খুবই ভয়ানক ব্যাপার। ফলে বোঝা যাচ্ছে রাজধানীর আরো অনেক এলাকাতেই অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আগে যেমন দেখতাম এডিস মশা বেশি প্রজননের ঝুঁকি ছিল ফুলের টবে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো পাত্রে, কিন্তু এখন আমরা খোলা ছাদে জমে থাকা পানিতেও এডিসের লার্ভা-পিউপা পাচ্ছি।
অধ্যাপক ড. মাহাবুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বের যেসব দেশে পানির প্রভাব বেশি এবং আবহাওয়া ঠাণ্ডা গরমের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে সেখানেই মশার উপদ্রব বেশি থাকে। তবে অন্য দেশগুলোতে বড় মশার চেয়ে লার্ভা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ বেশি থাকায় মানুষ আমাদের মতো এত অতিষ্ঠ হয় না। বাংলাদেশে যেসব সংস্থা মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত, তাদের উচিত অ্যাডাল্টিসাইডের চেয়ে লার্ভিসাইডের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া। পানির ওপর যদি লার্ভিসাইড পরিমাণমতো প্রয়োগ করা যায় তবে তো মশার প্রাথমিক জীবনচক্রের তিনটি ধাপই একসঙ্গে ধংস হয়ে যাবে, তখন বড় মশা আসবে কিভাবে। ফাঁক-ফোকর গলে যতটুকু থাকবে সেটা জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য। কারণ প্রটোকল অনুসারে মশা শতভাগ মেরে ফেলা যায় না; তাতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে।’

বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু যে খাল বা নালা-নর্দমার পানিতেই মশার জীবনচক্র বেড়ে ওঠে তা নয়, বরং গত বছর এক গবেষণায় দেখা যায়—পরিত্যক্ত যানবাহন, নৌবন্দর, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে কনটেইনার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে বৃষ্টির পানি জমে মশার প্রজনন সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ভবনের ছাদে, কার্নিশে বৃষ্টির পানি জমতে পারে। গাছের কোটরে, গাছে বড় পাতার ভাঁজে পানি জমতে পারে। ব্যক্তিগত বাগানে-খামারে, পার্কে, রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ে, গাছপালায় বিভিন্নভাবে স্বচ্ছ পানি জমার পরিবেশ থাকতে পারে, যা এডিশ মশার উপযুক্ত প্রজনন ক্ষেত্র।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালাউদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ড্রেন, নালা-নর্দমায় যথাসাধ্যমতো লার্ভিসাইড প্রয়োগ করছি। তবে সব জায়গায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে। যেমন : মানুষের পথচলার জন্য ফুটপাত তৈরি করতে গিয়ে ড্রেনগুলো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হচ্ছে। ফলে ওই ঢাকনার নিচে সঠিকভাবে লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ ছাড়া অনেক এলাকাতেই আমাদের ঢুকবার অধিকার নেই। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার আওতায় থাকা এসব এলাকার প্রজনন ক্ষেত্রে যদি তাদের নিজেদের উদ্যোগেই লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হয় তবে অনেকাংশে উপকার পাওয়া যাবে।’
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত খাল কিংবা নালা-নর্দমাগুলো যদি সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যায় এবং তাতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে পারা যায় তবে আমি মনে করি, ৭০ শতাংশ মশা এমনিতেই কমে যাবে।’
এদিকে মশার ওষুধের মানের প্রসঙ্গ তুলে সিটি করপোরেশনের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে তিন দফা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে বৈঠক করেছি। তাঁরা কেউ কেউ মশার ওষুধের কার্যকারিতা ও রেজিস্ট্যান্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু এর পক্ষে নিশ্চিত কোনো তথ্য-উপাত্ত জানাতে পারেননি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অনেক সময়ই শুনে থাকি সিটি করপোরেশনগুলো থেকে যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় সেগুলোর মান ভালো থাকে না। যে পরিমাণে পানি বা কেরোসিন মেশানোর নিয়ম, তার চেয়ে অনেক বেশি পানি মেশানো হয়। ফলে ওই ওষুধ আশানুরূপ কাজে আসে না। যদি ওই ওষুধ কাজেই আসত তবে এত মশার বিস্তার দেখতে হতো না। এ ক্ষেত্রে মশার ওষুধ কেনাকাটায় স্বচ্ছতার বিষয়টিতে সরকারের আরো নজরদারি বাড়ানো উচিত। নয়তো কেবল সভা-সমাবেশ করে কোনো লাভ হবে না।
ওই ওষুধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঘরে ঘরে মশা নিধনে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তা সঠিক ডোজ মেনে ব্যবহার ও সঠিক পদ্ধতিতে করা গেলে সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা হচ্ছে এই স্প্রেগুলোতে পারমেথ্রিন উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে না। আর ব্যবহারকারীরাও নিরাপদ ডোজ মানেন না, যা মানুষের জন্য বিপজ্জনকও। মশা মারতে গিয়ে মানুষ শেষ পর্যন্ত নানা রোগ বাধিয়ে বসছে।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/03/23/616672