১২ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ১০:৩৮

কী করলে সমাপনী ও জেএসসি বাতিল হবে বলতে পারেন?

পরীক্ষা নিয়ে অস্থিরতা ঘরে ঘরে- শেষ

রাজধানীর বনশ্রীতে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুলের সামনে বসে কথা বলার সময় এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন অনেক অভিভাবক। সবাই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে কথা বলতে শুরু করেন সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষার বিরুদ্ধে। একই সাথে তারা তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেন করেন সৃজনশীল নিয়ে। একজন অভিভাবক এতই ুব্ধ যে, তিনি বলেন, সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা বাতিলের জন্য কী করতে হবে বলেন আমাদের আমরা তাই করব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যদি মানববন্ধন করতে হয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তবু দাঁড়িয়ে থাকব। কিন্তু তার পরও চাই এ পরীক্ষা বাতিল হোক। অযথা হয়রানি আর কষ্ট ছাড়া এ পরীক্ষা আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এত অল্প বয়সে এত পড়ালেখার চাপ সহ্য করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে।
আরেক অভিভাবক কাতরস্বরে প্রশ্ন করেন, ‘কী করলে পরীক্ষটা বাতিল হবে বলতে পারেন?’
কাকরাইলের উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুলের অভিভাবক ইশরাত ফেরদৌসের ছেলে এবার সমাপনী পরীক্ষা দেবে। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে আকুতি জানিয়ে বলেন, আপনি আমাদের কষ্টের কথা তুলে ধরে একটি রিপোর্ট লেখেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে, যাতে তিনি এ পরীক্ষা দু’টি বাতিল করেন। আপনি এমনভাবে লেখেন যাতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সমস্যা বুঝতে পারেন এবং তার মন নরম হয়। ইশরাত ফেরদৌসের মতো একই আকুতি প্রকাশ করলেন অনেক অভিভাবক।
বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকদের সাথে কথা বলার সময় সবাই একটাই অনুরোধ করেনÑ সরকারকে বলেন পরীক্ষাটা যেন বাতিল করে। সরকার সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষা উঠিয়ে দিক। সৃজনশীল বাতিল করুক। আগের নিয়মই ভালো ছিল।

চতুর্থ শ্রেণীতেই সমাপনীর প্রস্তুতি!
রাজধানীর উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুলের অভিভাবক ইশরাত ফেরদৌস জানান, তাদের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে বছরের শুরু থেকে। সমাপনী পরীক্ষার আদলে সব পরীক্ষা নেয়া হয়। এক বছর ধরে তার সন্তানসহ চতুর্থ শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে এ প্র্যাকটিস করানো হয়েছে। এমসিকিউ পদ্ধতিতে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে প্রতি পরীক্ষায়। কিন্তু এ বছর জানতে পারলাম এমসিকিউ থাকবে না। শুধু তা-ই নয়, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে। অন্য দিকে মার্চ মাস শুরু হয়ে গেলেও এখনো সিলেবাস দেয়া হয়নি।

ইসরাত ফেরদৌস বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এক নিয়মে প্র্যাকটিস করার পর এখন আবার নতুন নিয়ম চালু করা হলো। প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে না পারার শাস্তি কি এভাবেই শিক্ষার্থীদের পেতে হবে?
একই প্রশ্ন এবং অভিযোগ আরো অনেক অভিভাবক আর শিক্ষকদের। এমসিকিউ বাতিল বিষয়ে অনেকের অভিযোগ না থাকলেও এমসিকিউ উঠিয়ে দিয়ে সব প্রশ্ন সৃজনশীল করার তীব্র বিরোধী প্রায় সব অভিভাবক।
আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখার একজন অভিভাবক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদককে জানান, তার সন্তানরা এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলের কাসের পাশাপাশি চারটি বিষয়ে সে কোচিং করছে। এখনই কেন কোচিং করাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তিনি। চারটি বিষয়ে কোচিং করানোর পরও তিনি তার সন্তানের পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে আতঙ্কিত। একই কথা জানালেন চতুর্থ শ্রেণীর আরো অনেক অভিভাবক। তাদেরও একই কথা। কোনো ঝুঁকি নিতে চান না তারা। পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতিতে হিসেবে এখনই তারা কোচিং প্রাইভেট শুরু করেছেন শিক্ষার্থীদের। কারণ সমাপনী আতঙ্ক। জিপিএ ৫ পেতে হবে। অভিভাবকেরা বলেন, অনেকের মধ্যে এখন থেকেই অস্থিরতা শুরু হয়েছে পরীক্ষা ঘিরে।

পঞ্চম শ্রেণীর অভিভাবকদের সাথে কথা বলার সময় তারা বলেন, কোচিং প্রাইভেট পড়ে না এমন কাউকে আপনি পাবেন না। দুয়েকজন থাকতে পারে। সৃজনশীলের নামে যা শুরু হয়েছে তাতে কোচিং প্রাইভেট ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রায় সবাই সব বিষয়ে কোচিং দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে মা-বাবার
অনেক অভিভাবক বলেন, সমাপনী পরীক্ষার কারণে সন্তানদের সাথে মা-বাবার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। ভালো রেজাল্টের জন্য সারাক্ষণ আমরা তাদের পড়ার চাপ দিচ্ছি। মারধর করছি। আর বকাঝকা তো রয়েছেই। এভাবে তাদের সাথে আমাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ছোট ছোট সন্তানদের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। অভিভাবক নিজাম উদ্দীন বলেন, সন্তানের লেখাপড়ার কারণে আমাদের আর কোনো শুক্রবার শনিবার নেই। আমরা ক্রমে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবার এখন একটাই চাওয়া আর তা হলো জিপিএ ৫।

রামপুরার অভিভাবক লাইলি বেগম বলেন, তার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য এত বেশি পড়ালেখা যে তা কল্পনা কর যায় না। শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই খারাপ লাগছে। পরীক্ষায় ভালো করতে হলে বিসিএস পরীক্ষার্থীর মতো সারা দিন রুমে বসে পড়ালেখা করতে হবে এই ছোট ছোট সন্তানদের। কোনো ধরনের খেলাধুলার সুযোগ তারা পাবে না। বই পড়ালেখা আর পরীক্ষার যে ধরন তাতে তাদের জন্য কোনো আনন্দ বিনোদনের সময় বের করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন অনেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে শিশুদের খেলার মাঠের জন্য সামাজিক আন্দোলন করছেন। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে কথা বলে যেটি বোঝা গেল তা হলো এভাবে যদি পরীক্ষা আর পড়ার নামে ভারী বোঝা শিশুদের ওপর চাপানো থাকে তাহলে এমন এক দিন আসবে যখন হয়ত খেলার মাঠ থাকবে কিন্তু তারা মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় আর পাবে না।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/301013