১২ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ১০:২৭

প্রশ্ন তৈরির প্রক্রিয়াতেই গলদ

প্রশ্নফাঁসে জড়িত শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা চাওয়া হয়েছে * পরবর্তী বৈঠক ১৩ মার্চ

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা বোর্ডের নানা গলদ খুঁজে পেয়েছে এ সংক্রান্ত হাইকোর্ট গঠিত প্রশাসনিক কমিটি। সমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস রোধে নেয়া ব্যবস্থাও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে স্মার্ট ফোন নেয়া নিষিদ্ধ থাকার পরও বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে তা পাওয়া গেছে। সকাল সাড়ে ৯টার আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হয়নি। রোববার পর্যন্ত পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি এসব তথ্য পেয়েছে। কমিটির একাধিক সদস্য যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চিহ্নিত শিক্ষক ও কর্মচারীদের নামের তালিকা তলব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাত দিনের মধ্যে জানতে চাওয়া হয়েছে চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রোববার ছয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে।

রোববার ছিল হাইকোর্ট গঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক। এদিন কমিটির সদস্যরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া সরেজমিন দেখতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে যান। তারা প্রশ্ন তৈরির প্রক্রিয়া, স্থান এবং নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপের পর তারা এসব তথ্য জানতে পারেন। সূত্র জানায়, ঢাকা বোর্ডের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে প্রশ্ন প্রণেতারা বা পরিশোধনকারীরা কাজ করেন। ওই সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ওই কক্ষে পাঠ্যবই এবং কলম ছাড়া অন্য কিছু নিতে পারেন না বলা থাকলেও তিনি আরও কিছু সঙ্গে নেন কিনা, সেটি নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ইলেকট্রনিক কোনো যন্ত্র কারও সঙ্গে কক্ষের ভেতরে গেল কিনা এবং প্রশ্নপত্রের ছবি বেরিয়ে গেল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

কমিটির আরেক সদস্য জানান, দ্বিতীয় বৈঠকের আগে কমিটির সদস্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা পরীক্ষা কেন্দ্রে স্মার্ট মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা নিয়ে কিছু তথ্য দেন কমিটির সদস্যদের। মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা কমিটিকে বলেন, ভেতরে কেন্দ্র সচিবের একটি নন-স্মার্টফোন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও কেন্দ্র পরিদর্শনকালে খোদ শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের সামনেই ওই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। সেটি ছিল স্মার্ট ফোন। এ ছাড়া সাড়ে ৯টার আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলা পাওয়া যায় বিভিন্ন কেন্দ্রে। সেই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সোহেল রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘রোববার আমাদের দ্বিতীয় বৈঠক ছিল। প্রাথমিক আলোচনা শেষে আমরা ঢাকা বোর্ডে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া দেখতে যাই। সেখানে বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সদস্যরা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। তবে ফাইন্ডিংস সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না।’

তবে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, পরিদর্শনকালে তারা বোর্ডের কোন রুমে কোন প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন তৈরি হয়, কে বা কারা প্রশ্ন তৈরি করেন- এরকম নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। পাশাপাশি ক’টি ধাপে প্রশ্ন তৈরি হয়, তৈরি হওয়া প্রশ্নপত্র পরিশোধন (মডারেশন) প্রক্রিয়া কী, এরপর সেটি কিভাবে বিজি প্রেসে মুদ্রণের জন্য পাঠানো হয় সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে কমিটির সদস্যরা কথা বলেন।
জানা গেছে, কমিটি আগামীকাল ১৩ মার্চ তৃতীয় বৈঠকে বসবে। এদিন তারা বিজি প্রেসে প্রশ্ন মুদ্রণ প্রক্রিয়া সরেজমিন দেখতে যাবেন। বর্তমানে বিজি প্রেসে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মুদ্রণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার।
কমিটির তিনজন সদস্য যুগান্তরকে জানান, আগামী ২ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। বর্তমানে বিজি প্রেসে প্রশ্ন ছাপার কাজ চলছে। ফলে পরিদর্শনের সময় তারা বিজি প্রেসের দিক থেকে নেয়া নিরাপত্তা ও অন্যান্য দিক দেখতে পারবেন।

উল্লেখ্য, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ফেব্র“য়ারি হাইকোর্ট দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি, অপরটি প্রশাসনিক কমিটি। প্রশাসনিক কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। ছয় সদস্যের কমিটিতে আরও আছেন বুয়েট অধ্যাপক সোহেল রহমান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য, সফটওয়্যার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর প্রতিনিধি শাহরুখ আহমেদ এবং পুলিশের সিআইডির একজন সদস্য। আগামী ৬ এপ্রিল এই কমিটির মেয়াদ শেষ হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত মাসের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল করতে চাই। আমাদের কার্যক্রম চলছে।’ তিনি বলেন, ‘মূলত প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে চাই আমরা। সেটা সম্ভব হলেই কাজ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এরপর আমরা সুষ্ঠু পরীক্ষা গ্রহণে প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত সুপারিশ করব।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/26528