১২ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ১০:২৪

কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদী পানিশূন্য ॥ হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করালগ্রাসী খরস্রোতা ধরলাসহ ১৬টি নদ-নদী শুকিয়ে ধু-ধু বালু চরে পরিণত হয়েছে। খেয়াপারে বা মাছ ধরতে বর্ষায় নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝি-মাল্লাদের দৌড়ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ ধরলার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর। মাছ ধরতে না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে নদী তীরবর্তী হাজারো জেলে পরিবার। বিপন্ন হতে চলেছে নানা প্রকার জীববৈচিত্র্য।

ধরলার সুস্বাদু কর্তী, বরালি, আইড়, বাইন, চিলকি, বাঘাআইড়, কনে, পাপদা আর আগের মত জেলেদের জালে ধরা পড়ে না। মাছ না পাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার জেলে পরিবার। ঋণের জালে জড়িয়ে পৈত্রিক ব্যবসা ছেড়ে কাজের সন্ধানে কেউ পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কেউ অটোরিক্সা চালান, কেউ বা চালানি মাছের ব্যবসা করেন, কেউ হয়েছেন দিন মজুর। খাদ্য আর বাসস্থানের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে কয়েক প্রজাতির পাখি।

ধরলা, তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র, গংগাধর, ঝিনজিরাম, হলহলিয়া ও দুধকুমরসহ সব নদীর বুকে ধু ধু বালু চর পড়ায় হারিয়ে যাচ্ছে ডাবকি, হাড়গিলা, শল্লী, কোড়া, শামকুড়া, চখা-চখী, পানকৌড়ি, দলপিঁপি ইত্যাদি পাখি। এক সময় নদীর চরে দাপিয়ে বেড়াতো গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি গৃহ পালিত প্রাণী। গৃহস্থদের যার পালে যত বেশি গরু, মহিষ থাকতো তার সামাজিক মর্যাদা ততো বেশি হত। নদীর পানি কমে যাওয়া, ঘন ঘন নদীর গতিপথ পরির্বতন, নদীর চরে কৃষি কাজ শুরু হওয়ায় গরু, মহিষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এখন চরে রাখালের বাঁশির সুর আর শোনা যায় না। সারাদিন চলে কৃষকের খোড়াখুড়ি। ফলে চর থেকে উধাও হয়ে গেছে কাশবন, ঝাউবন, ও কাটাবন। পানির অভাবে জীববৈচিত্রসহ সকলের জীবন আজ বিপন্ন হতে চলেছে। অথচ একদিন ধরলার রুপ, লাবণ্য, ঐতিহ্য সবই ছিল টইটুম্বুর।

৩০/৩৫ বছর আগেও ধরলা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম। লালমনিরহাট, ফুলবাড়ি, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম এবং চিলমারীর বন্দর হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য আনা নেয়া হত বড়বড় নৌকায় করে। পালতোলা নৌকার বাহারী রংয়ের মেলায় সু-সজ্জিত থাকতো নদীগুলো। ১৫ শতকে চাঁদ সওদাগর তার চৌদ্দ ডিঙ্গা নিয়ে ধরলা নদী দিয়ে ভারত, চীন, প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্য করার লোক কাহিনী এখনো মানুষের মুখে মুখে।
আজ শুধুই ইতিহাস। পানির অভাবে ধু-ধু প্রান্তরে পরিণত হওয়ায় সব নদীর বুকে কৃষকেরা মাঝে মাঝে বোরো ধান চাষ করছেন। পানি কমে, চর পড়ায় সব নদী মৃত প্রায় । এখনই ব্যবস্থা না নিলে এক সময়ের উত্তাল ধরলা নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহলের দাবি।

কুড়িগ্রাম মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ধরলার বুকজুড়ে বাস করত ৩০ প্রজাতির মাছ। পানি না থাকায় আজ সেগুলো বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭ প্রজাতির মাছ। আর প্রাণিসম্পদ অফিসের সূত্রমতে, ধরলায় বাস করা ৩০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অধিকাংশই এখন বিপন্ন প্রায়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও রিভারাইন পিপলসের পরিচালক নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন-শুধু ধরলা নয়, অন্যান্য নদীতেও পানি সঙ্কটের কারণে উত্তরাঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন-ধরলাসহ উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য নদী এখন শুধুই ইতিহাস। আগামী প্রজন্ম জানবেই না নদী নামের শব্দটি।

http://www.dailysangram.com/post/322277