২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:০৭

কথা সত্য মন্ত্রী তো প্রশ্ন ফাঁস করেননি

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : প্রশ্ন ফাঁস এক মহামারি রূপ নিয়েছে। এমন কোন পাবলিক পরীক্ষা নেই এ পর্যন্ত যার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় নাই। বিসিএস পরীক্ষা, ব্যাংকে চাকরি পরীক্ষা, প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যাবতীয় পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেদারসে ফাঁস হচ্ছে। বেদিশা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে এক এক সময় এক এক কথা বলেছেন। কখনো বলেছেন, আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, কখনো বলেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করে দেয়া হবে। কখনো বলেছেন প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার। কিন্তু তার এইসব ফাঁকা আওয়াজে কোনো কাজ হয় নাই। তিনি এ ধরনের হাবিজাবি কথা বলেই গেছেন। আর প্রশ্ন যারা ফাঁস করেছে তারা ফাঁস করেই যাচ্ছে। তাদের টিকিটিরও নাগাল করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা মন্ত্রী।

এমনিতে আমরা দেখি কেউ যদি ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর নামে কটূক্তি করে কিংবা কোনো কার্টুন-টার্টুন তৈরি করে তবে অতি দ্রুত সরকারের ‘দক্ষ’ গোয়েন্দা বা পুলিশ বাহিনী একেবারে তার বেডরুমে গিয়ে তার টুঁটি চেপে ধরে নিয়ে আসে। তারপর আইসিটি আইনে মামলা দেয়। জামিন অযোগ্য আইনে এভাবে বহু তরুণ অকারণে জেলে পচছে। কি হয় যদি উচ্ছ্বসিত তারুণ্য দু’চারটা কথা বলেই বসে। প্রধানমন্ত্রী ফেরেস্তা নন। তাছাড়া তিনি তো দাবি করেন যে তিনি জনগণের প্রতিনিধি। তাহলে এইটুকু সহ্য করার ক্ষমতা তার থাকবে না কেন? আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনের কুৎসিত দিক নিয়ে একজন বই লিখেছেন ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি। সে বই যাতে প্রকাশ হতে না পারে সে চেষ্টা ট্রাম্প করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। ট্রাম্প আদালতে যাবার হুমকি দিয়েছিলেন। ফলে পাবলিশার বইটির প্রকাশ আরো কয়েক দিন আগায়ে দেয়। তারপর সেই বইয়ের হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কই! ট্রাম্প প্রশাসন তো কটূক্তির দায়ে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় নাই। এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সরকার সেই সৌন্দর্য নস্যাৎ করে দিয়েছে। আগে পত্রিকাগুলোতে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিদের নানা ধরনের কার্টুন প্রকাশিত হতো। কিন্তু পাছে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানহানি হয়, সে চিন্তা করে পত্রিকাগুলো এখন আর কার্টুন প্রকাশ করে না। ভয় পাচ্ছে, পাছে নাকি প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়ে যায়। কিন্তু তারুণ্য সব সময় ভয় করে চলে না। তার নিজস্ব সাহস আছে, নিজস্ব কথা বলার ধরন আছে, সে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। এই সমাজ তাদের সৃষ্টিশীলতাকে প্রশংসা না করে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখছে।

তাহলে আমাদের দক্ষ পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনী আজ পর্যন্ত কেন প্রশ্ন ফাঁসে হোতাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। এ এক বিরাট প্রশ্ন। কখনো আমরা দেখেছি প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ, কখনো শুনেছি প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বিজি প্রেস থেকে, কখনো শুনেছি প্রশ্ন ফাঁস করছেন শিক্ষকরাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। কোনো কূল-কিনারাই করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বরং কোমলমতি শিক্ষর্থীদিগকে উন্মাদের মতো আটক করে তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। আসলে শিক্ষা মন্ত্রী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধংস করার মিশন নিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি একেবারে তছনছ করে ফেলেছেন। ভুল-ভাল, বানান ভুল, কবিতা ভুল, উদ্ধৃতি ভুল, লেখকের নাম ভুল এই সমস্ত দায়সারা দায়িত্বহীন কা- করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। সে ক্ষেত্রেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন হয়নি, কোনো মহল থেকেই তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত মনে হলো, হাল ছেড়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ক’দিন আগে শিক্ষা সচিবকে বলতে শুনলাম, প্রশ্ন ফাঁস রোধ করার সম্ভব ন। তারচেয়ে বরং পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের বই খুলে প্রশ্নের জবাব লেখার ব্যবস্থা করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।

আসলে লজ্জা বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তিরোহিত হয়ে গেছে। কেননা, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তারা যে অপারগতা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এতো অপারগতা আর কখনো দেখা যায়নি। একবার দেখা গিয়েছিল ১৯৭২ সালে। তখন ছাত্রলীগের ছেলেরা বাইরে থেকে খাতা লিখিয়ে হলের খাতা রেখে বাইরের খাতা জমা দিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস তখন হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় বহু শিক্ষার্থীকে দেখেছি ফাঁস হওয়ার প্রশ্নের ধারেকাছেও যায়নি। তারা যেটুকু লেখাপড়া করেছে সেটুকু দিয়েই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে। যারা খাতা বদল করে বাইরে থেকে লেখানো খাতা জমা দিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গিয়ে তারা বেশির ভাগই ঝরে পড়েছে। পরে অবশ্য বিষয়টি আর তেমন থাকেনি। পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে এসেছিল। এখন একেবারেই গড়ের মাঠ। সবকিছু উন্মুক্ত, উন্মোচিত। কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই আর গোপন রাখা যাচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রীকে ক’দিন আগে বলতে শুনলাম তার পদত্যাগের সময় নাকি এখনো আসেনি। শিক্ষা সচিব বাহাদুর এতো যে অহঙ্কার করে বললেন, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়, সেটিও নিঃসন্দেহে চরম দায়িত্বহীনতা। এই শিক্ষা মন্ত্রলালয়ের অধীনেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে এ লেবেল ও লেবেল পরীক্ষা হচ্ছে, কিন্তু কই তার তো কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো না। অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরিষার ভূত সে পর্যন্ত কখনো পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং সে সব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে আরও চমৎকার বাণী শুনলাম প্রধানমন্ত্রীর মুখে। সম্প্রতি ইটালি ও ভ্যাটিকান সফর শেষে গত সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন ফাঁসের দানবদের পক্ষ অবলম্বন করে বললেন, মন্ত্রী আর সচিব গিয়ে তো প্রশ্ন ফাঁস করেননি, তাদের কেন সরে যেতে হবে? যারা করেছে তাদের ধরিয়ে দেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। কি দারুণ কথা! এ কথা তো সত্য যে, আমরা কেউ শিক্ষা মন্ত্রী বা সচিবকে প্রশ্ন রাস্তায় ফেরি করতে দেখিনি, বলতে শুনিনি ‘এই প্রশ্ন লাগবে? প্রশ্ন?’ কিন্তু দায়িত্বটা তাহলে কে নেবে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা প্রশ্ন ফাঁস করেছে তাদের ধরিয়ে দেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এরকম আজব কথাও আগে কখনো শুনিনি। আমরা যদি ধরিয়ে দিতে পারবো তাহলে সরকার আছে কেন? সরকারের তবে কি দায়িত্ব? জনগণের পয়সায় মন্ত্রীগিরি ফুটানিগিরি করবেন, আর জনগণের শিক্ষা ধংস করে দেবেন তা তো হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বা নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন তাদের ধরিয়ে দিলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু তার সরকার তাহলে কি করছে? যদি কোথাও খুন হয়, ডাকাতি হয় তবে তার বিচার হবে না? সরকার কি তবে বলবে যে, খুনি বা ডাকাতকে ধরে এনে পুলিশের হাতে তুলে দিন, বিচার করা হবে। তাহলে এ বিশাল পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, র্যা ব বাহিনী এরা আছে কিসের জন্য? তাদের দায়িত্ব তবে কী। এটি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী বরং প্রশ্ন ফাঁসকে আরো এক ধাপ উসকে দিয়েছেন। বলেছেন প্রশ্ন ফাঁস নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে ২০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা আগে, এতো ট্যালেন্ট কোন ছাত্র যে এই সময়ের মধ্যে পড়ে মুখস্থ করে লিখবে? যুক্তি অদ্ভূত। অর্থাৎ প্রশ্ন ফাঁস রোধ তার সরকার কিছু করতে পারবে না। বরং প্রশ্ন ফাঁস হলে হবে ট্যালেন্টের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যা মাত্র ২০ মিনিটে বা ১ ঘণ্টায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারবে। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন ফাঁসকে বরং জাস্টিফাই করলেন।
এখন সরকারের ভেতরেও সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত সর্বত্রই শিক্ষা মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগের জোর দাবি উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রী শুধু প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে তার ক্যালাস মন্তব্যের জন্যই কুখ্যাত হয়ে ওঠেননি, বরং তিনি দুর্নীতি সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন যে, ‘আপনারা সহনীয় পর্যায়ে ঘুষ খাবেন, ঘুষ খেতে না বলার নৈতিক সাহস আমার নেই, কারণ আমি ঘুষ খাই, মন্ত্রীরা ঘুষ খায়’। তার এই বক্তব্যের পর সংসদে দাবি উঠেছিল, এজন্য পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। সে রকম ক্ষমা শিক্ষামন্ত্রী চেয়েছেন বলে শুনিনি, আর ক্ষমা চাইলেই বা নাগরিক হিসেবে আমার কি লাভ? ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু ঘুষ খাওয়ার যে পারমিশন তিনি দিলেন তা তো বহালই থেকে গেল। সে জন্য এখন সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের যে মহোৎসব নাহিদ শুরু করেছেন, তাতে এই ছাত্রদের চূড়ান্ত পরিণতি দাঁড়াবে দুর্নীতির মহোৎসব। তারা যখন এরকম বেপথে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, তখন ঘুষ দুর্নীতিই তাদের ভরসা হবে। নাহিদ তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।

এদিকে দায়িত্ব অবহেলা ও বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ এনে শিক্ষা মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ দাবি করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রাথমিক সমাপনী, এসএসসি, এইচএসসিসহ সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রী ব্যর্থ হওয়ায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে তার পদত্যাগ চেয়ে এ নোটিশটি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন। তিনি জানান, প্রাথমিক, সমাপনী জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষাসহ সব পাবলিক পরীক্ষার ফাঁস বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রী ব্যর্থ।
সুতরাং তার ওই পদে থাকার অধিকার নাই। তার স্থলে সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যিনি সংসদ সদস্য নন, এমন একজন শিক্ষায় অসামান্য দক্ষ ও উচ্চ শিক্ষিত নাগরিককে শিক্ষামন্ত্রী করতে এ নোটিশ। পানি যখন অনেক দূর গড়িয়ে গেছে তখন প্রধানমন্ত্রী একেবারে তাদের আগলে ধরেছেন। যুগ যুগ ধরেই নাকি প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এটি নতুন কিছু না। সুতরাং শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা। তার জয় হোক।

 

http://www.dailysangram.com/post/319901