২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২০

বিদেশে চলে যাচ্ছে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা

জাহাজ কমার কারণ নীতি সহায়তার অভাব * ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা

আমদানি-রফতানির পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি টাকা (এক ডলার ৮২ টাকা হিসাবে) বিদেশে চলে যাচ্ছে; যা মোট রফতানি আয়ের ১৮ শতাংশের বেশি। বিশাল অংকের এই টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার কারণ হল বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়া। নীতি সহায়তার অভাবে গত ৪ বছরে জাহাজের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। আর ভাড়া বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা কোম্পানিগুলো বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একটি সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি পর্যালোচনা করতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৭৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি-রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি হয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর রফতানি হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ আমদানি-রফতানির প্রায় ১০ শতাংশ জাহাজ ভাড়া বা ফ্রেইট চার্জ হিসেবে ব্যয় হয়, টাকার অংকে যা প্রায় ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলো ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের (৯ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা) পণ্য পরিবহন করে। বাকিটা চলে যায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর পকেটে। অর্থাৎ ভাড়া বাবদ ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (৫০ হাজার কোটি টাকা) বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো নিয়ে যাচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৬৩টি বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল। এর মধ্যে বেসরকারি জাহাজ ছিল ৫২টি। এরপরের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জাহাজের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৭টিতে। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাহাজের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ৩৮টিতে। এর মধ্যে যথাক্রমে বেসরকারি জাহাজের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৭টি ও ৩৮টিতে। মূলত জাহাজ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় এই দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। এ কারণে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রফতানি কমে গেছে, যা মোট বাণিজ্যের ৫ শতাংশেরও কম।

জানা যায়, এনবিআর ১৯৯৪ সালের ৯ জুন একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৩ হাজার টনের বেশি (ডেডওয়েট টনেজ বা ডিডব্লিউটি) ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ আমদানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়। যেটি ২০১২ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটি বাড়িয়ে ৫ হাজার টনের বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজের ক্ষেত্রে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু পরের বাজেটে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। সেই থেকে জাহাজ আমদানি বা উৎপাদন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছে। এ কারণে জাহাজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি অনুযায়ী আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে ৫০ শতাংশ বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের মাধ্যমে করার সুযোগ আছে। কিন্তু জাহাজ স্বল্পতার কারণে ৫ শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এ বিশাল সুযোগ বাংলাদেশি জাহাজ মালিকরা কাজে লাগাতে পারছে না। উল্টো সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশি জাহাজ মালিকরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার যেখানে নিজেদের শিপিং লাইনকে সমৃদ্ধ করতে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে পুরো উল্টো চিত্র। ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার টনের বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সুরক্ষার কথা বলে, সেটিকে ৫ হাজার টনের উন্নীত করা হয়। সেটার যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু ৩ বছর আগে কাউকে কিছু না জানিয়ে জাহাজ আমদানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। ফলশ্র“তিতে জাহাজের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরাতন জাহাজ আর রিপ্লেসমেন্ট করা হয়নি। এতে জাহাজের সংখ্যা কমতে কমতে গত ৪ বছরে অর্ধেকে নেমে আসে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্প দুর্দিন পার করছে। তাছাড়া ৫ হাজার টনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজও দেশে তৈরি হয় না। এ অবস্থায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলেও জাহাজ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া উচিত। এতে আমদানি করা জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ করে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে। পাশাপাশি অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে অধিক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম হবে। যথাযথ নীতি-সহায়তা দিয়ে এ খাত চাঙ্গা করলে একদিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার গড়ে উঠবে, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রেমিট্যান্স পাঠাবে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওশানগোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ বশির উদ্দিন যুগান্তর বলেন, ‘আমদানি-রফতানি বাণিজ্য যে হারে বেড়েছে, তা পরিবহনে বাংলাদেশের অন্তত ২ হাজার সমুদ্রগামী জাহাজের প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের আছে ৩৮টি। এ কারণে বিশাল অংকের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জাহাজ আমদানিতে শুধু ভ্যাট অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় নয়, সরকারকে আরও প্রণোদনা দেয়া উচিত। তাহলে টাকা দেশে থাকবে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, জাহাজ আমদানি ও উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। সামগ্রিক দিক তুলে ধরে শিগগিরই অর্থমন্ত্রীর কাছে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হবে। অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দিলেই নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/19569