২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:১৭

ঋণের সুদ হার বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগ

ব্যাংকের সুদ হার বাড়লে আমানতকারিরা লাভবান হলেও বিনিয়োগ কমে যায়। এতে করে দেশের বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যায়। যা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ দিনের দাবিতে গত বছর ঋণের সুদ নেমে এসেছিল এক অংকের ঘরে। তবে চলতি বছরের শুরুতে তা আবার চলে গেছে দুই অংকের ঘরেই। ঋণের সুদ নিয়ে বছরখানেক স্বস্তিতে থাকলেও আবার তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেই পুরনো সমস্যা। এতে উদ্বেগ বাড়ছে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতের সুদ হার কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদ সামান্য বেড়েছে। মূলত এডিআর রেশিও কমানোর কারণে তা হচ্ছে। আমানতের সুদ কমলে তা আবার সমন্বয় হয়ে যাবে।

তবে সুদ হার যেন স্প্রেডসীমা (ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান) লঙ্ঘন না করে সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত হাতে দমন করতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংকিং খাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হতে পারে। প্রতিটি ব্যাংক আমানত বাড়াতে নিজেদের ইচ্ছা মত ব্যাংক সুদ হার নির্ধারণ করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর রেশিও (আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ) কমিয়ে দেয়। এতে কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দেয় তারা। আমানতের সুদ বাড়ানোর কারণে ঋণের সুদও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। এতে বিপদে পড়ে গেছেন ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা উদ্যোক্তারা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়ার কারণে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমে যাবে। বাড়বে ব্যবসার খরচ। ফলে পণ্যের দাম বাড়বে। যা উদীয়মান অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। তারা বলছেন, ঋণের সুদ এক অংকে এনেও দৃশ্যমান বিনিয়োগ তেমন বাড়ানো যায়নি। বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি পেলেও আসলে এ বিনিয়োগ কোথায় হলে তা এখনও দৃশ্যমান নয়।
তাদের অভিযোগ বিনিয়োগের নামে টাকা নিয়ে তা কাজে না লাগিয়ে পাচার হচ্ছে। আর এ বিনিয়োগে অজুহারে আবারও ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এতে করে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। উৎপাদন কমবে। বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। বেকারত্ব আগের চেয়ে অনেক বাড়বে।
ঋণের সুদ বাড়ার কারণে বিনিয়োগে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহ-সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।
তিনি বলেন, কেন্দীয় ব্যাংকের এবারের মুদ্রানীতি কিভাবে বিনিয়োগ বান্ধব হলো, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সুদ হার বাড়লে অবশ্যই ব্যবসার ব্যয় বাড়বে। বিনিয়োগ কমবে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। আর এর পুরো প্রভাব পড়বে ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।

শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, আমরা এখনও এসএমই খাতে এক অংক সুদে ঋণ নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা ভাবনার বিষয়। এর মধ্যে আবারও বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সুদ। এটা ব্যবসার জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসায় বড় ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ প্রতিযোগিতার মধ্যে ঋণের সুদ হার দুই অংকের ঘরে যাওয়া আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, সুদ বাড়লে বিনিয়োগ কমবে। আর তখন কর্মসংস্থান কমার পাশাপাশি কমবে রপ্তানি আয়ও। যা সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ঋণের সুদ হার বাড়ানো ঠিক নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরাও। তাদের মতে, স্প্রেডসীমা আরো কমিয়ে আনলে ঋণের সুদ বাড়তো না।
প্রচলিত নিয়মে প্রয়োজনে টাকা দেবে ব্যাংক। আর ব্যাংকেই যদি টাকা না থাকে, তবে গ্রাহক যাবে কোথায়? গ্রাহক বলতে বিশেষত শিল্পোদ্যোক্তারা আর আগের মতো ব্যাংকের ঋণ পাবেন না। কারণ, ব্যাংক নিজেই টাকার পেছনে ছুটছে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যক্তির পুঁজির দিকেই আকৃষ্ট হয়ে নানাজনের কাছে ধরণা দিচ্ছে। কর্মকর্তাদের টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছে। অফার করা হচ্ছে বাড়তি সুদও।

দেখা গেছে, একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমানতের আবদার করছেন। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। নিয়ম না মেনেও কোনো কোনো ব্যাংক বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে- যা গোটা ব্যাংকিং খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) বাস্তবায়ন, কয়েক মাস ধরে আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেয়াসহ কয়েকটি কারণে তারল্য সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। ঋণ প্রদানে লাগাম টেনে তারা এখন আমানত বাড়াতে ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। বিশেষ করে সরকারি অর্থ আমানত রাখতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অথচ কয়েক মাস আগেও এই পরিস্থিতিটা ছিল ঠিক উল্টো। তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মনোযোগ ছিল ঋণ প্রদানে প্রতিযোগিতা করা। আমানত সংগ্রহে আগ্রহ ছিল কম। ফলে স্প্রেডসীমা (ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান) ৫ শতাংশ থাকার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংকেরই এই হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। তাই সবাই আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি আমানত সংগ্রহ করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। তবে শিগগিরই তারল্য বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঋণের তুলনায় আমানত কিছুটা কমেছে। তাই সরকারি আমানত থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

সম্প্রতি এডি রেশিও কমিয়ে সাধারণ ব্যাংকের জন্য সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ ও ইসলামী ধারার ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণ প্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি। এসব কারণে তারল্যে টান পড়ছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আমানত নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকগুলোও এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। এই জন্য সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ সুদ চায়।

ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে আমানত নেয়ার জন্য বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন, ব্র্যাক, দ্য সিটি, সাউথইস্ট, ঢাকা ব্যাংকসহ প্রথম সারির ব্যাংকগুলো দৌড়ঝাঁপ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ঋণের সুদ বাড়ানো মোটেও ঠিক হবে না। পৃথিবীর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড স্প্রেড রেট হলো সাড়ে ৩ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল বলে তা ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। তারপরও বিদেশী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। যা অনুচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফরাস উদ্দিন বলেন, যারা স্প্রেডসীমা লঙ্ঘন করে তাদের খুব শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। কারণ সুদ হার বাড়লে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, এডিআর রেশিও কমে যাওয়ায় আমানতের সুদ হার বেড়েছে। আর আমানতের সুদ বাড়ায় ঋণের সুদ হার কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ঋণের চাহিদা বেশি থাকায়ও সুদ বেড়েছে। তাছাড়া সুদ হার নির্ভর করে বাজারের উপর। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে না। আমানতের সুদ কমলে ঋণের সুদও কমে যাবে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

ব্যাংকের তারল্য সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বলেন, ব্যাংকিং খাতে কোন তারল্য সংকট নেই। মুদ্রা বাজার স্বাভাবিক রয়েছে এনিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্ন হলো তাহলে কোন ঋণের সুদ হার বাড়ছে। ব্যাংকগুলো প্রতিদিনের লেনদেন করছে ধার দেনা করে। তারল্য সংকট না থাকলে কেন ধার দেনা করবেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান মনে করেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর উন্নয়নে ব্যাংকারদের মানসিকতাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারি, সেবার মান ও ব্যাংক লুটের বিচারহীনতা সব মিলিয়েই ঘুরে ফিরে আলোচনায় ব্যাংকখাত। এ সংকট থেকে আমাদের উত্তর প্রয়োজন।
অর্থপ্রতিমন্ত্রী মনে করেন, এসব নিয়ে রীতিমত অস্বস্তিতে আছে সরকার। এ অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে সবাইকে আরও সর্তক থাকবে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যাতে এ খাতকে পিছে না ফেলে সে দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী মনে করেন, সবার আগে সরকারি ব্যাংকগুলোতে দক্ষ লোকবল বাড়ানো উচিত। দক্ষ জনশক্তিই পারে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে। ব্যাংকগুলোতে আরও গবেষক বাড়াতে হবে। কেন আমাদের এ সংকট তা বের করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/319750