১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:০৭

৬ দেশে কর্মী প্রেরণে নির্দেশ লঙ্ঘন

২৯ হাজার ৭২ কোটি টাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে

দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী না পাঠিয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। আর সংসারের অভাব দূরের কথা, ব্যয়ের টাকা উঠাতেই বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন প্রবাসীরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ১০ লক্ষাধিক কর্মী বিদেশে গেছে। মোট অভিবাসন ব্যয় ছিল ৪৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে গেলে এই ব্যয় হতো ১৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। ২৯ হাজার ৭২ কোটি টাকা বেশি নিয়ে গত বছর ছয়টি দেশে ৯ লাখের বেশি শ্রমিক রপ্তানি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন স্বপন উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে কর্মী পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১১০০ থেকে ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে এক লাখের বেশি সাব-এজেন্ট। রিক্রুটিং এজেন্টের চেয়ে সাব-এজেন্টদের সঙ্গে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। দেশি-বিদেশি এই সাব-এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।’

প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের স্বজন, রিক্রুটিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর এই ছয়টি দেশ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ২৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ছয়টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করতে গিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি, সাব-এজেন্ট ও দালালরা বিদেশে যাওয়া কর্মীদের কাছ থেকে আদায় করেছে আনুমানিক প্রায় ৪৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ১৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অতিরিক্ত ২৯ হাজার ৭২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় রিক্রুটিং এজেন্ট, সাব-এজেন্ট, দালালসহ মধ্যস্বত্বভোগীরা।
মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারে কর্মীপ্রতি অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকা কৌশলে আদায় করে নিয়েছে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু লোকজন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী গেছে ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন। এসব কর্মীপ্রতি সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দুই লাখ ৬০ হাজার থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দুই লাখ ৬০ হাজার থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা নিলেও মাঠপর্যায়ের মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে খরচ হয়েছে আনুমানিক প্রায় তিন হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। কর্মীপ্রতি অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। এভাবে মালয়েশিয়া থেকেই গত বছর ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে প্রায় এক হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি প্লাস চুক্তির পর জানানো হয়, ৩৭ হাজার টাকায় কর্মী যেতে পারবে মালয়েশিয়ায়। কিন্তু কর্মী যাওয়া শুরু হলে সেই ৩৭ হাজার টাকায় কর্মী পাঠাবে দূরের কথা তিন লাখ টাকার বেশি নিয়ে কর্মী পাঠাতে থাকে রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন। পাল্টা এক লাখ টাকায় কর্মী পাঠানোর একটি প্রস্তাব পাঠায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। বায়রা থেকে এমন প্রস্তাবের পর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এই টাকায়ও এখন কর্মী পাঠাচ্ছে না এজেন্সি। তারা দুই লাখ ৬০ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করছে। এই টাকা নেওয়ার রসিদও দেওয়া হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্তের কথা বলা হলেও নিয়ন্ত্রণ আছে ১০ এজেন্সির কাছে। তাদের মাধ্যমেই অন্য এজেন্সিগুলো লোক পাঠায়। এভাবে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ১০ এজেন্সি। মেডিক্যাল ফির নামে প্রতি কর্মীর কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা, যা এক হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা না। এভাবে তিন লাখের মতো কর্মীর মেডিক্যাল পরীক্ষা আর বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারের নামে ১০টি এজেন্সি হাতিয়ে নিচ্ছে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা। মেডিক্যাল কারা করতে পারবে এ নিয়েও চলে বৈষম্য।
একইভাবে ওমানে ৮৯ হাজার ৭৪ জন কর্মী গেছে ২০১৭ সালে মাথাপিছু তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে। মোট অভিবাসন ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ে গেলে খরচ হওয়ার কথা ৮৯৭ কোটি টাকা। ওমানে সরকার অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়েছে এক লাখ ৭৮০ টাকা। অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে প্রায় এক হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা বেশি আদায় করেছে এজেন্সি, দালাল ও সাব-এজেন্টরা।
আর মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতার। গত বছর দেশটিতে কর্মী গেছে ৮২ হাজার ১২ জন। সরকারিভাবে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৭৮০ টাকা। নেওয়া হচ্ছে প্রায় তিন গুণ বেশি টাকা। সরকারের নির্ধারিত টাকায় কর্মী পাঠালে খরচ হতো ৮২৬ কোটি টাকা। কুয়েতে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮০ টাকা সরকারিভাবে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা করে। এভাবে ২০১৭ সালে কুয়েতে পাঠানো ৪৯ হাজার ৬০৪ জন কর্মীর কাছ থেকে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা হারে প্রায় দুই হাজার ৪৮০ কোটি টাকা আদায় করে নেওয়া হয়। সরকারি হিসাবে ৫২৯ কোটি টাকায় ওই সব কর্মীকে কুয়েতে পাঠানোর কথা থাকলেও এক হাজার ৯৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত হিসেবে আদায় করে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

আর সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় না থাকায় রিক্রুটিং এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্টরা ছয় থেকে সাত লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। গত বছর ৪০ হাজার ৪০১ জন কর্মী গেছে সিঙ্গাপুরে। এসব কর্মীর কাছ থেকে আনুমানিক প্রায় দুই হাজার ৪২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্টরা।
বেশি অর্থ খরচ করে বিদেশে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকেই কাজও খুঁজে পাচ্ছে না। পেলেও তা এত কম যে অভিবাসন ব্যয় ওঠাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/19/604024