১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:০৬

ছয় অস্ত্রধারী এখনও নাগালের বাইরে

ঘটনার শুরু সাত মাস আগে। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রামে সংঘটিত তিনটি হত্যাকাণ্ড ও একটি সংঘর্ষে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করেছিল সেলিমসহ ছয় অস্ত্রধারী; কিন্তু এখনও তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করে বিচার না করায় তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। বাড়ছে অস্ত্রধারীদের বাগাড়ম্বর।

চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসার সামনে গত ৬ অক্টোবর নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে খুন করে ফেরার সময় পাঁচ রাউন্ড গুলি করে কথিত ছাত্রলীগ কর্মী জাহেদুর রহমান ও রুবেল দে ওরফে চশমা রুবেল। ট্রাকচালকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বলায় গত ৩ ডিসেম্বর পরিবহন ব্যবসায়ী হারুনকে গুলি চালিয়ে খুন করে মো. জসীম ওরফে কালা জসিম ও তার ভাই হৃদয়। গত ১৬ জানুয়ারি দিনদুপুরে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে। ওই সময় সাব্বির খানের হাতে যে অস্ত্রটি ছিল, সেটির উৎস ছিল মহসিন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এনাম হোসেন। গত বছরের ১২ জুলাই ছাত্রলীগের দু'পক্ষের সংঘর্ষ চলার সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে বাকলিয়ার বগারবিল এলাকার কথিত যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সেলিম।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কুসুম দেওয়ান সমকালকে বলেন, 'অস্ত্রধারীদের কোনো দল থাকতে পারে না। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের দলীয় পরিচয় বিবেচনার প্রশ্নই আসে না। পালিয়ে থাকায় তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অবশ্যই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।'

সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ায় বাসার সামনে খুন হন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ ঘটনায় গ্রেফতার মোক্তার হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ পাপ্পু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। জবানবন্দিতে তারা জানায়, সুদীপ্তকে পিটিয়ে হত্যার সময় মানুষ এগিয়ে আসতে চাইলে পাঁচ রাউন্ড গুলি চালায় জাহেদুর রহমান জাহেদ ও রুবেল দে ওরফে চশমা রুবেল। তাদের মধ্যে রুবেল ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতে নিহত তাপস সরকার হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। তবে চারমাস পেরুলেও এ দু'জনের হদিস পায়নি পুলিশ। তবে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, কিছুদিন আগে লালখানবাজার এলাকায় জাহেদকে প্রকাশ্য দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে সদরঘাট থানার পরিদর্শক তদন্ত মোহাম্মদ রুহুল আমীন সমকালকে বলেন, 'সুদীপ্ত হত্যার পলাতক অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর অন্যরা গা-ঢাকা দেওয়ায় তাদের এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে।'

নগরের ডিটি রোডে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে খুন হন পরিবহন ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ। এ ঘটনায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি আসামি মো. মামুন হোসেন ও ১১ ফেব্রুয়ারি আসামি মো. আলমগীর ওরফে শরবত আলমগীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এতে তারা উল্লেখ করে, গত ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হারুনকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিচতলা থেকে টেনে বের করে আনে কালা আলমগীর। এরপর হারুনের কোমরে থাকা পিস্তল কেড়ে নিয়ে হারুনেরই বুকে গুলি করে সে। পরে তার ভাই হৃদয় নিজের পিস্তল দিয়ে আরেক দফা গুলি করে। এ ঘটনার দুই মাস পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে এই দুই সহোদর। তারা নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ী চট্টলা বেকারি মোড় এলাকার আলুওয়ালার বাড়ির জানে আলমের ছেলে।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদরঘাট থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ অলিউলল্গাহ সমকালকে বলেন, 'হারুন খুনে অস্ত্র ব্যবহারকারীদের তথ্য-প্রমাণ পুলিশের কাছে আছে। তবে যাদের নাম এসেছে, তারা উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। তাদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আদালতের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

গত ১৬ জানুয়ারি দিনদুপুরে নগরের জামালখান আইডিয়াল স্কুলের বিপরীতে কলেজিয়েট স্কুলছাত্র আদনান ইসপারকে প্রকাশ্য খুন করা হয়। এ সময় আদনানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছিল মো. সাব্বির খান নামে এক কিশোর। ঘটনার পরদিন রাতে সাব্বিরসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সাব্বির খান জানায়, ঘটনার সময় ব্যবহূত ওই পিস্তল তাকে মহসিন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এনাম হোসেন দেয়। ঘটনার একমাস পূর্ণ হলেও রাউজান উপজেলা এলাকার ছেলে এনামকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

আদনান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'আদনান হত্যায় ব্যবহূত অস্ত্রটি এনামের বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিল সাব্বির। অস্ত্রটি এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এনামকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।'

চট্টগ্রাম কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১২ জুলাই ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি চালায় বাকলিয়ার বগারবিল এলাকার কথিত যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সেলিম। সাত মাস পেরুলেও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি চকবাজার থানা পুলিশ। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, 'যার হাতে অস্ত্র ছিল সংঘর্ষের পর থেকে সে পালিয়ে আছে। তাই তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে চেষ্টা চলছে।'

অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করা না গেলে সন্ত্রাসীদের আস্ম্ফালন আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন। তিনি সমকালকে বলেন, 'সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখার কোনো সুযোগ নেই। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে গেলে সমাজে খুনোখুনি, সংঘাত ও মারণাস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হবে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।'

http://samakal.com/whole-country/article/1802899