১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:০২

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে এই অজুহাতে স্থানীয় পর্যায়ে তেলের দাম সমন্বয়ের কথা বলেছে সংস্থাটি। বিপিসি’স এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা লোকসান গুনছে শুধু ডিজেলেই। ক্যাব মনে করে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির এখতিয়ার বিপিসি’র নেই। এজন্য তাদেরকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে।

সূত্র জানায়, চলতি মাসের ৭ তারিখে বিপিসি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠিতে বলেছে, ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০১৬ সালের ২৪শে এপ্রিল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম হ্রাস করে পুনঃনির্ধারণ করে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবর ২০১৬ হতে ফার্নেস অয়েলে এবং নভেম্বর ২০১৭ হতে ডিজেল ও কেরোসিনের ক্ষেত্রে বিপিসি লোকসান শুরু করে। চিঠিতে আরো বলা হয়, ইতিমধ্যে বিপিসি কর্তৃক স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সমন্বয়ের একটি প্রস্তাব এই বছরের ২৮শে জানুয়ারি মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। সেখানে চলতি মাসের ৬ই ফেব্রুয়ারি তথ্য অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশি মুদ্রার হিসেবে ডিজেলের প্রতি লিটার ৮৮ দশমিক ১১ টাকা এবং পেট্রোল ১০১ দশমিক ১৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা বাংলাদেশ থেকে প্রতি লিটারে যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৯৬ টাকা এবং পেট্রোলে ১৫ দশকি ১৭ টাকা বেশি বলে উল্লেখ রয়েছে। সংস্থাটি তার প্রস্তাবে দামের পার্থক্যে আস্তে আস্তে কমানোর কথা বলেছে। এতে মানুষ অভ্যস্ত হবে বলে সংস্থাটি মনে করে।

সূত্র আরো জানায়, ভারতে ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রতি লিটার ৮৭ টাকা করে ডিজেল বিক্রি হয়েছে। আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি। সুতরাং দাম বাড়লে মানুষ এটা ধীরে ধীরে গ্রহণ করবে। অসুবিধা হবে না। সরকার ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বিপিসি’র কাছ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এর আগের অর্থবছরে নিয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা। এটা লভ্যাংশ, ভ্যাট, ট্যাক্স বাদ দিয়েই দেয়া হয়েছে সরকারকে। এ বছর আগেই দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বছরের দু’বার তেলের দাম সমন্বয় করলে ক্ষতি হবে না, এমন ফর্মুলা তারা সরকারকে জানিয়েছে।

বিপিসি’স এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা লোকসান গুনছে শুধু ডিজেলে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি পর্যায়ে প্রতি লিটার ডিজেলে খরচ পড়ে ৮০ টাকা।
বিপিসি’র সূত্র মতে, জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ডিজেল। দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ৫৮ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৪০ লাখ ৪৪ মেট্রিক টন ছিল ডিজেল। ফার্নেস অয়েল ৮ লাখ ৬ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন এবং পেট্রোল ও অকটেন সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। গত ডিসেম্বরের তথ্যমতে, প্রতিদিন চাহিদা ছিল ৭২ হাজার মেট্রিক টন, জানুয়ারিতে ছিল ৯৮ হাজার মেট্রিক টন।
এ প্রসঙ্গে বিপিসি’র পরিচালক (মার্কেটিং) মীর আলী রেজা মানবজমিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার প্রস্তাব দিয়েছি। বাড়ানো-কমানো সরকারের উপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৩৫ ডলার থেকে ৮০ ডলারে উঠেছে। এছাড়া ডলারের মূল্য একসময় ৮২ টাকা ছিল, এখন তা ৮৩ টাকার উপরে। প্রতিদিন ১০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ভারতের চেয়ে প্রতি লিটার ডিজেল ২৩ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। ফার্মেস অয়েল ১২ টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতি লিটারে। ডিজেলে এখন ৪ টাকা ক্ষতি (তেল আগে কিনা ছিল) হলেও অচিরেই ১০ থেকে ১২ টাকা ক্ষতি হবে।
গত ২৪শে এপ্রিল, ২০১৬ থেকে জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়। ডিজেল ও কেরোসিনে ৩ টাকা এবং পেট্রোল ও অকটেন লিটারে ১০ টাকা কমানো হয়েছিল ওই সময়ে। তবে তেলের দাম কমার পরও গণপরিবহনের ভাড়া তেমন কমেনি। ডিজেল, কোরোসিন পেট্রোল ও অকটেনের দাম গড়ে সাত দশমিক ৩৩ শতাংশ কমানো হয়েছিল। ডিজেল ও কোরোসিন লিটার প্রতি তিন টাকা এবং অকটেন ও পেট্রোলে লিটার প্রতি ১০ টাকা কমানো হয়েছে। এর আগে ফার্নেস তেলের দাম লিটারে ১৮ টাকা কমিয়ে ৪২ টাকা করা হয়। তারও আগে ২০০৯ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। ডিজেল ও কোরোসিন ৬৮ টাকা থেকে লিটার প্রতি তিন টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। ডিজেল ও কোরোসিন গড়ে চার দশমিক ৪১ শতাংশ কমে। পেট্রোল ৯৬ টাকা থেকে ১০ টাকা কমিয়ে ৮৬ টাকা অর্থাৎ ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং অকটেনে ৯৯ টাকা থেকে ১০ টাকা কমিয়ে ৮৯ টাকা অর্থাৎ ১০ দশমিক ১০ শতাংশ কমানো হয়। গড়ে সাত দশমিক ৩৩ শতাংশ তেলের দাম কমানো হয়। এর আগে ওই বছরের ৩১শে মার্চ ফার্নেস তেলের দাম লিটার প্রতি ১৮ টাকা কমিয়ে ৪২ টাকা করা হয়। সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে ৪৫ শতাংশ। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ২৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৯ শতাংশ, শিল্প খাতে ৪ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ও অন্যান্য খাতে ৭ শতাংশ। বিপিসি সূত্র জানায়, ডিজেল ও কেরোসিনে তিন টাকা কমানোর পরও ওই সময়ে লিটার প্রতি লাভ ছিল ১৭ টাকা। অকটেনে লিটার প্রতি লাভ হয় ২৫ টাকা এবং পেট্রোলে লিটার প্রতি লাভ হয় ২০ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রিতে লাভ হয়েছে ১০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, জ্বালানি তেলের দাম ২০১৩ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বাড়ানো হয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ১২০ থেকে ১২৫ মার্কিন ডলারে ওাা-নামা করছিল। তখন দেশে দাম বাড়িয়ে প্রতিলিটার অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রোল ৯৬, ডিজেল ও কেরোসিন ৬৮ এবং ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকা করা হয়।
বিশ্ব বাজারের অব্যাহত পতনের মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে শুরু করে। প্রায় দুইবছর ধরেই জ্বালানি তেলে লাভ করেছিল বিপিসি। ওই সময়ে জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো বাজেট ঘাটতি মেটাতে বেশি বেশি জ্বালানি বিক্রি করে। গত নভেম্বর থেকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় বিশ্ববাজারে সামান্য পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে।

এদিকে, ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকার ফলে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন মুনাফা করছে। চলতি অর্থবছর বিপিসি সর্বোচ্চ নিট মুনাফা হয়েছে ৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ১৩ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছর (২০১৫-১৬) ছিল ৯ হাজার ৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা। তেলের দাম ধাপে ধাপে কমে চার বছরে তিন ভাগের একভাগে নেমে আসার পর সরকারের বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে একদফা দাম কমায় সরকার। ২০১২ সালে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ১০৫ ডলার, যা কমতে কমতে ২০১৬ সালে ৩০ ডলারে নেমেছে। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের ২৪শে এপ্রিল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪ শতাংশ এবং অকটেন ও পেট্রলের দাম ১০ শতাংশের মতো কমানো হয়। মাঝখানে কয়েক বছর মুনাফা করলেও দীর্ঘদিন লোকসান দিয়েছিল বিপিসি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে তারা। এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসি’র মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৯৬৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরের লোকসানের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৩৭১ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির এখতিয়ার বিপিসি’র নেই। এজন্য তাদেরকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মাধ্যমে প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে। এর ব্যর্থ ঘটলে আইন সম্মত হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মন্ত্রণালয়ে দাম বৃদ্ধি প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লো বা কমবে তাতে কি আসে-যায়। প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসিতে আসতে হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=105629