১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:৫৪

আবার বাড়ছে চালের দাম

চালের কৃত্রিম সঙ্কট থেকে উত্তরণে এবং চালের দামের লাগাম হাতে রাখতে সরকার আমদানি, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও কোন কিছুতেই কাজে আসছে না। গত বছরের শুরু থেকে দেশে চালের দাম বাড়তে থাকে। সরকারের নানা পদক্ষেপে, এতে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও, তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতনদের উসকানিমূলক বক্তব্যে বাড়ছে চালের দাম। এর পেছনে বাণিজ্য ও খাদ্যমন্ত্রীকে দায়ী করছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। উত্তাপ কমতে না কমতেই ফের বাড়তে শুরু করেছে চালের বাজার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ দেড় টাকা। তবে সরু চালের দাম বেড়েছে আরেকটু বেশি, কেজিতে তিন টাকা পর্যন্ত। একইভাবে বেড়েছে খুচরা পর্যায়েও। রাজধানীর বাজারে ভারতীয় মোটা চাল কেজিপ্রতি ৪৪ ও দেশি মোটা চাল ৪৫-৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের ভারতীয় চালের দর কেজিপ্রতি ৪৬-৪৮ টাকা। আর দেশি মাঝারি মানের চালের কেজি ৫২-৫৪ টাকা। বিক্রেতারা দেশি সরু মিনিকেট চালের কেজিপ্রতি দর মানভেদে ৬০-৬৩ টাকা ও ভারতীয় মিনিকেট ৫৮ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

এ বিযয়ে ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এসএম নাজির হুসাইন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে ‘অতি ব্যবসায়ীবান্ধব’ আখ্যায়িত করে বলেন, চাল নিয়ে দুই মন্ত্রীর পরস্পর বিরোধী বক্তব্যই দায়ী-এ বৃদ্ধিও জন্য দায়ী। তারা জনগণের স্বার্থে কথা না বলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বেশি দেখছেন। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। কারসাজিতে জড়িত মিল মালিকদের পক্ষ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এটা চালের দাম বাড়াতে উস্কে দেওয়ার শামিল বলে মন্তব্য করেন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল আমদানি নিয়ে জাতীয় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তোফায়েল আহমেদ বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। অপরদিকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে আট লাখ টন দেশের বন্দরে এসে পৌঁছেছে। দেশে বর্তমানে খাদ্য ঘাটতি নেই বলেও খাদ্যমন্ত্রী দাবি করেন।
গত বছর হাওরে আগাম বন্যায় ফসলহানির পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুই দফা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া রোগবালাইয়ের কারণেও ধানের ফলন অনেক কম হয়। হাওরে ফসলহানীর পর থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। চালের সরকারি মজুদ তলানিতে নেমে এলে দফায় দফায় বাড়ে দাম। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দুই শতাংশে নামিয়ে আনে সরকার। এছাড়া সরকারি মজুদ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেস্ট নাজির হুসাইন বলেন, সরকার কখনো কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনে না। মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ক্রয় করে। তারা সরকারের দুর্বলতার সুযোগে নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়ায়। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে চালের মজুদ যথেষ্ট থাকলেও সরকারি পর্যায়ে মজুদকৃত চাল সরবরাহে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। সঠিকভাবে এই চাল সরবরাহ করা হলে চালের দাম আরও কমত। চালসহ নিত্যপণ্যে দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ক্যাবের পক্ষ থেকে পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে জানিয়ে নাজির বলেন, এ বিযয়ে করণীয় ঠিক করতে শিগগিরই ক্যাব বসছে। তারা ওই দুই মন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান তিনি। নির্বাচনের বছর তাই আরও সতর্ক ও জনবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দেন ক্যাবের এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
এদিকে বাবু বাজারের মেসার্স শিল্পী রাইস এজেন্সীর সত্বাধিকারী মো. কাওসার হোসেন বলেন, ভারতীয় মোটা চাল কেনা পড়ছে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা দরে। এর সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ যোগ করে ৪৪ টাকার কমে বিক্রি করা যায় না। তিনি বলেন, কয়েক দিনে সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে।

চালের বাজার আবার চড়তে থাকার কারণ হিসেবে ভারতের বাজারে পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ভারত থেকে চাল আমদানিতে আগের চেয়ে টনপ্রতি ২০-৩০ ডলার বেশি ব্যয় হচ্ছে। বাড়তি মূল্যে আমদানি করা এ চাল স্থানীয় বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের একজন চাল ব্যবসায়ী জানান, আমদানিকৃত চালের দামের উঠা-নামার সুযোগ নিচ্ছে একটি সিন্ডেকেট। আমদানিকারকরা যেভাবে দাম নির্ধারণ করছেন, আমাদেরকেও সে দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানে কোন মনিটরিং হচ্ছে কি না-জানতে চাইলে ওই ব্যবসায়ী জানান, আমদানিকৃত চালের ওপর যথাযথ মনিটরিং হচ্ছে না। মনিটরিং হলে চালের দাম চালের দাম আরও কমত বলে দাবি করেন এ ব্যবসায়ী।
একই ধরনের কথা বলেন সেগুনবাগিচা বাজারের চালের ক্রেতা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের আশা ছিল, চালের দাম আরও কমবে কিন্ত দাম আবার বাড়ায় আমরা শঙ্কিত। এত আমদানি হওয়ার পরেও চালের দাম কেন এত বেশি হবে? সরকার কেন মনিটরিং করছে না। তিনি বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে অস্থিতিশীল চালের বাজার কখনও দেখিনি। এতে করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন এই ক্রেতা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে সাত লাখ ৬১ হাজার টন। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির পরিমাণ ২১ লাখ ২৯ হাজার টন, যার সিংহভাগই এসেছে ভারত থেকে। এ চালের বড় অংশই ব্যবসায়ীরা এনেছেন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। আমদানির এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় বেশি।
হিলি স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগেও ভারত থেকে মানভেদে প্রতি টন স্বর্ণ চাল আমদানি হতো ৪২০-৪৩০ ডলারে। একই চাল আমদানিতে এখন ব্যয় হচ্ছে ৪৪০-৪৪৫ ডলার। একইভাবে রতœা জাতের চালেও টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে স্থলবন্দরটি দিয়ে প্রতি টন ভারতীয় রতœা চাল ৪৪০-৪৫০ ডলার মূল্যে আমদানি হলেও এখন ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৭০ ডলার। বাড়তি দামে আমদানি করা প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল ৩৮ থেকে সাড়ে ৩৮ টাকায় বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা। একই চাল এক সপ্তাহ আগে তারা বিক্রি করেছিলেন কেজিপ্রতি সাড়ে ৩৬-৩৭ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি রতœা চাল ৩৯ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা।
ভারতে চালের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন স্থানীয় মিলাররাও। ফলে কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজধানীতেও সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রাজধানীর পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম কেজিতে এক টাকা বাড়লেও খুচরায় বেড়েছে আড়াই টাকা পর্যন্ত।

নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বলেন, দেশে বর্তমানে চালের কোনো সংকট নেই। ভারত থেকেও পর্যাপ্ত চাল আমদানি হচ্ছে। তবে বর্তমানে ভারত সরকার চাল সংগ্রহ করায় সে দেশে দাম কিছুটা বেড়েছে। আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও। ভারতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় মিল মালিকরাও সরবরাহ সীমিত করে এনেছেন। দু-একদিনের মধ্যে দাম বাড়িয়ে তারা সরবরাহ স্বাভাবিক করবেন।

মিল থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ার জন্য ধান সঙ্কটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী। তিনি বলেন, ধানের অভাবে অনেক মিল বন্ধ থাকায় চাল সরবরাহ কমে গেছে। এছাড়া বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। ভারত থেকে আমদানি মূল্যও বেড়েছে। এ কারণে চালের বাজার একটু বাড়তির দিকে রয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/117840