২ জানুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ২:১৯

কী মধু জেলা পরিষদে!

দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে অবাধে ভোট কেনাবেচা হয়েছে। এক ভোট বিক্রি হয়েছে একাধিকবার।
যে প্রার্থী বেশি টাকা দিতে পেরেছেন, ভোট পড়েছে তাঁরই পক্ষে। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের ভোট ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ইউপি সদস্যদের ভোট বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। টাকা দিয়েও যাঁরা ভোট পাননি তাঁরা এখন ভোটারদের পেছনে ছুটছেন অর্থ ফেরত নিতে। এ নিয়ে বিভিন্ন জেলায় হুমকি-ধমকি, এমনকি লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটছে। এমন নগ্নভাবে ভোট কেনাবেচা হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, জেলা পরিষদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের দেখভাল এবং জেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্ভাব্য ভূমিকাই এসব পদকে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তুলেছে।
স্থানীয় সরকার-সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মর্যাদা এখনো নির্ধারিত না হলেও প্রতিটি জেলার অধীন একাধিক সংসদীয় আসন, পৌরসভা এবং বেশ কিছু উপজেলা থাকায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মর্যাদা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। জেলার সব উন্নয়নকাজ তদারকির ক্ষমতাও এই পরিষদকে বেশি আকর্ষণীয় করেছে। এ ছাড়া জেলা পরিষদের নির্বাচকমণ্ডলী তথা ভোটারসংখ্যা অনেক কম হওয়ায় ভোট কেনাটাও সহজ হয়েছে। ফলে বেশ কিছু জেলায় দলীয় প্রধানের মনোনয়ন অগ্রাহ্য করেই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন দলের কোনো কোনো নেতা, যাঁরা সংশ্লিষ্ট দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পান।
সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, এখনো জেলা পরিষদের ক্ষমতা সেভাবে না দেখা গেলেও জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী সরকার ইচ্ছে করলে পরিষদের কাছে কিছু দায়িত্ব দিতে পারে। সেগুলো প্রয়োগে তারা হয়তো নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করতে পারে। এ ছাড়া জেলায় যেহেতু মাত্র একজন চেয়ারম্যান তাই তিনি হয়তো সেভাবেই জেলাবাসীর কাছে পরিচিত হবেন, মর্যাদা পাবেন। এসব কারণেই হয়তো জেলা পরিষদের মতো নির্বাচনেও টাকা ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জেলা পরিষদের কার্যাবলি হবে দুই প্রকারের। আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক আইন অনুযায়ী পরিষদ বিশাল সম্পদ দেখভাল ও উন্নয়নকাজ তদারকির ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। বিধি অনুযায়ী সরকারের অনুমোদনক্রমে পরিষদ যেকোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম বা প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করতে পারবে। বিদ্যমান আইনের ৩১(১) ধারা মতে, জেলার উন্নয়নের প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা পরিষদের থাকবে।
বর্তমানে একটি জেলা পরিষদের অধীন শতকোটি টাকার সহায়সম্পদ রয়েছে, যা ইজারা দিয়েও অনেক টাকা আয় করতে পারবে পরিষদ। এ ক্ষেত্রে একজন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ইজারার বাইরেও অনেক অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। আর উন্নয়নকাজ তদারকিতেও তাঁদের গুরুত্ব থাকবে। বর্তমানে জেলার অধীন সব ধরনের জমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সময় রাজস্ব আয়ের ১ শতাংশ জেলা পরিষদের কাছে যায়। এ ছাড়া সরকারও প্রতি বছর পাঁচ থেকে ১০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে একটি জেলা পরিষদ সম্পদের ভাণ্ডার হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, উন্নয়নকাজ তদারকি বা সম্পদ ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঘাপলা বা অনিয়ম হলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিষদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এ জন্য আগে থেকে জানাতে হবে। বিদ্যমান জেলা পরিষদ আইনের ৭৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, পরিষদের বিরুদ্ধে বা পরিষদ-সংক্রান্ত কোনো কাজের জন্য এর কোনো সদস্য বা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হলে মামলা দায়ের করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে মামলার কারণ এবং বাদীর নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে পরিষদের ক্ষেত্রে পরিষদ কার্যালয়ে নোটিশ দিতে হবে; এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সদস্য, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে বা তাঁর অফিস কিংবা বাসস্থানে নোটিশ পৌঁছে দিতে হবে। ৭৬(২) ধারা মতে, ওই নোটিশ প্রদান বা পৌঁছানোর পর ৩০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না এবং মামলার আরজিতে ওই নোটিশ প্রদান করা বা পৌঁছানো হয়েছে কি না তার উল্লেখ থাকতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের এ বিধানের সুযোগে পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্যরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে কেউ মামলা করতে চাইলেও নোটিশ দেওয়ার সময়ই তাঁকে ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। আইনের এই সুবিধাও একটি ক্ষমতা বলছেন।
সংশ্লিষ্ট আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার পরিষদের ওপর সাধারণ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে এ-সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট পরিষদের চেয়ারম্যানকে অবহিত করা এবং চেয়ারম্যান ও পরিষদের কর্মকর্তাদের আইনানুগ কর্তৃত্ব প্রয়োগে সহায়তাদান করা সব পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জেলায় জেলা প্রশাসক সরকারের পক্ষে রাজস্ব সংগ্রহ করেন, আর জেলার আইনশৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান করে পুলিশ সুপারের কার্যালয়। এখন থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদেরও কর্তৃত্ব থাকবে, যদি সরকার সেভাবে চায়। বর্তমান জেলা পরিষদ আইনে এর ইংগিতও দেওয়া আছে।
ঢাকার খুব কাছের একটি জেলার নবনির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে ডিসি-এসপিরা জেলা পরিষদ প্রশাসকদের সেভাবে মূল্যায়ন না করলেও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে এখন বেশি মূল্যায়িত হবেন। আগে মন্ত্রণালয় থেকে সেভাবে চিঠি দিলেও কোনো অনুলিপি জেলার অন্য সংস্থানে দেওয়া হতো না। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সেটা করা হবে। অনুলিপি যাঁরা পাবেন তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই জেলা পরিষদের মূল্যায়ন সেভাবে হবে। এ ছাড়া একটি জেলায় একজন চেয়ারম্যান হিসেবে আমাদের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই আগের চেয়েও অনেক বাড়বে। ’
জেলা পরিষদ আইনের ২৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে অথবা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার সময় সময় তত্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে সরকার কর্তৃক পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্ম জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় ও নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর করিবার নির্দেশ দিতে পারিবে। ’
বিদ্যমান আইনের ২৭(২) ধারা মতে, জেলা পরিষদের বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে—জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা; উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা; সাধারণ পাঠাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ; উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা বা সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত নয় এমন জনপথ, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন; রাস্তার পাশে ও জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ; জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ; সরকারি, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভার রক্ষণাবেক্ষণে নয় এমন খেয়াঘাটের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ; সরাইখানা, ডাকবাংলা ও বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।
এত ক্ষমতা সত্ত্বেও বিদ্যমান আইনেই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বরখাস্ত করার ক্ষমতাও সরকারের রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে সরকার বা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করতে পারবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি জেলায় যেহেতু আগে থেকেই স্থানীয় সরকারের অনেকগুলো অংশ কাজ করছে, তাই নবনির্বাচিত জেলা পরিষদের হাতে এমন কোনো ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না যাতে অন্যদের মধ্যে সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হয়। তাই বলা যায়, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা যেমনভাবে নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করছেন তা শুধু সরকারের কারণে। যদি সরকার না চায় তবে তাঁরা হয়তো আগের জেলা পরিষদ প্রশাসকদের মতোই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে পারেন। তবে যেহেতু নবনির্বাচিত সব চেয়ারম্যানই সরকারি দলের লোক, তাই জেলার সংসদ সদস্যদের বাইরে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা কতটা ক্ষমতাবান হবেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/01/02/447810