২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১৭

নিখোঁজদের পরিবারে আশার আলো

‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো আশার আলো দেখছে। পরপর কয়েকজন ফিরে আসায় এখন তারা ভরসা পাচ্ছেÑ ‘তাদের স্বজনও ফিরে আসতে পারেন যেকোনো সময়’। ইতোমধ্যে যারা ফিরে এসেছেন তাদের পরিবারগুলোতে এখন আনন্দ বইছে। যারা এখনো ফেরেননি তাদের পরিবারগুলো অপেক্ষা করছে।
‘নিখোঁজ’ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফিরে এসেছেন। তবে ফেরেননি এমন সংখ্যাই বেশি। যারা ফিরেছেন তারা নিজেদের ভাগ্যবানই মনে করছেন। এসব ভাগ্যবানের মধ্যে রয়েছেন কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান। চার মাস নিখোঁজ থাকার পর ২২ ডিসেম্বর রাতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। এরপর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। আমিনুর রহমানের এক সহকর্মী বলেছেন, গ্রেফতার দেখানো হলেও আমিনুর রহমান ফিরে এসেছেন এটাই তাদের সান্ত্বনা। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় খোঁজ পাওয়া যায় উৎপল দাসের। উৎপল দাস দুই মাস ১০ দিন নিখোঁজ ছিলেন। গতকাল উৎপল বলেন, এখন বেশ ভালোই লাগছে। গত ১০ অক্টোবর অফিস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন উৎপল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোবাশ্বার হাসান সিজার গত ২১ ডিসেম্বর রাতে ফিরে এসেছেন। গত ৭ নভেম্বর কর্মস্থল থেকে বনশ্রীর বাসায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন সিজার। গত তিন মাসে খোদ রাজধানীতেই নিখোঁজ হয়েছেন ১৩ জন। এদের মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যে ফিরেছেন।

ফেরেননি যারা তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। গত ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ভিয়েতনামের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান (৭০)। পারিবারিক সূত্র জানায়, ৪ ডিসেম্বর রাতে মারুফ জামান তার বাসায় ফোন দিয়ে তার রুমে থাকা ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কাছে দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। রাতে কয়েক ব্যক্তি গিয়ে ওগুলো নিয়ে যায়। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও এবিএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ সাদাত আহমেদ এবং কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশরাক এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আরো যারা ফিরেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা অসিত ঘোষ অসিত, বেলারুশের অনারারি কনস্যুলার অনিরুদ্ধ কুমার রায়, দক্ষিণ বনশ্রীর নকিয়া-সিমেন্সের সাবেক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আসাদ, এভেনটিস-সনোফির ফার্মাসিস্ট জামাল রহমান, শাজাহানপুর থেকে ফল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন ও গুলশানের প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম।

এর আগেও অনেকে ফিরে এসেছেন। গত ১১ জুন ভোরে বাড়ি ফেরেন লক্ষ্মীপুর থেকে হারিয়ে যাওয়া রাকিবুল হাসান রকি। কে বা কারা তাকে গাড়িতে করে এনে শহরের বাগবাড়ি এলাকায় ফেলে রেখে যায়। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় ডাক্তার ইকবাল মাহমুদকে। গত ৩১ মে রাতে কে বা কারা তাকে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার নতুন গরুহাটা এলাকায় রেখে যায়। গত ৩ মার্চ ফিরে এসেছেন বিএনপি নেতা হুমাম কাদের চৌধুরী। ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে তুলে নেয়া হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরীকে। ৩ মার্চ ভোরে তিনি ফিরে আসেন। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের দেলপাড়া এলাকার ভূইয়া ফিলিং স্টেশন এলাকা থেকে অপহৃত হন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক। ওই বছরের ১৮ এপ্রিল মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় কে বা কারা তাকে ছেড়ে দিয়ে যায়। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ একদল অচেনা লোক উত্তরার ভাড়াবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বিএনপির তৎকালীন মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমদকে। প্রায় দুই মাস পরে ভারতের শিলং থেকে উদ্ধার করা হয় সালাহউদ্দিনকে। গত বছরের ১৬ মার্চ নিখোঁজ হন আইটি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা। কয়েক দিন পরে বিমানবন্দর এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যান। গত বছর বাসা এবং আদালতপাড়া থেকে তুলে নেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আমান আজমি ও ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমানকে।

এ দিকে মাসের পর মাস বছরের পর বছর অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ফিরে আসায় ওই সব পরিবারও এখন আশার আলো দেখছে। গত ১ জুন বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন তিন তরুণ। কামাল হোসেন, ইমাম হোসেন ও হাসান মাহমুদ নামে ওই তিন তরুণ বনানীর মোস্তফা ম্যানশনের পৃথক দুইটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে অপহৃত হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। তার গাড়িচালক আনসার আলীকেও তুলে নেয়া হয়। আজো হদিস মেলেনি তাদের। ২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে অপহৃত হন বিএনপি নেতা ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম। ২৫ জুন রাত ৮টায় ফার্মগেটের বাসায় যাওয়ার পথে তার গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়। এর পর থেকে তার কোনো হদিস নেই। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি লাকসাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ, রাজধানীর দক্ষিণখানের ছাত্রদল নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্না (২৪), ঝিন্টু (২৪), কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান সেন্টু, বংশাল থানার সহসভাপতি সোহেল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো: জহির ও সাধারণ সম্পাদক মো: পারভেজ, ৭২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহসভাপতি ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সদস্য সাব্বির, বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: চঞ্চল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য মো: কালু, সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আনিসুর রহমান ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো: বিপ্লব এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মিঠুকে উঠিয়ে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে। আজো তাদের হদিস মেলেনি। ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাযহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিয়াউর রহমান, গোপালগঞ্জের বোড়াশী পশ্চিমপাড়ার মান্দারতলা এলাকার উবায়দুর, কাশিয়ানি উপজেলার দক্ষিণ ফুকরার মিল্টন বাজার এলাকার মাহবুব, আওয়ামী লীগ নেতা নুর মোহাম্মদ হাজী, তার জামাতা, নজরুল ইসলাম বাছা, ব্যবসায়ী হুমায়ুন, কামরাঙ্গীরচরের মাওলানা শামীম, ওয়ালি উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আবদুল করিম হাওলাদার, রাজধানীর মিরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালাম শেখ, তার মামাতো ভাই আবুল বাশার শেখ, আবদুল করিম ও আতাউর রহমান ওরফে ইস্রাফিল, পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসায়ী রেজাউল করিম রিজভী, সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী তারিব উদ্দিন আহম্মেদ, শাহজাহানপুর থেকে দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলাম, জিন্দাবাহার লেন এলাকার ব্যবসায়ী আয়নাল মোল্লা, কামরাঙ্গীরচরের আবদুল আজিজ লেনের বাসিন্দা সুলতান হাওলাদার, রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, ফকিরেরপুলের হোটেল অবসরের সামনে থেকে ফেনীর সারোয়ার জাহান বাবুল, রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে ব্যবসায়ী মমিন হোসেন, রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপা জামে মসজিদের ইমাম ও গোদাগাড়ী পালপুর ধরমপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম, মালিবাগ থেকে অপহৃত ভোলার আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, আকাশ ও মিরাজ, হাতিরপুল এলাকা থেকে নিখোঁজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, মাসুম হোসেন, ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী তাবির উদ্দিন আহম্মেদ রানা। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে নিখোঁজ তপন দাস। ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তুষার ইসলাম টিটু, ফার্মগেটের ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, ব্যবসায়ী জহির রায়হান হিরণ, ব্যবসায়ী হাজী ওয়াজি উল্লাহ, সিদ্ধিরগঞ্জের সানাপাড়ের ইউনুস মুন্সি, তার মামাতো ভাই শেখেন মাতবর, তাদের সঙ্গী হাফিজুল ইসলাম স্বপন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার মোজাফফর, ব্যবসায়ী শহীদুর রহমান, সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: মাসুদ, যাত্রাবাড়ীর গোলাম মুর্তাজা, বরিশালের করিম কুঠির এলাকার আলী হায়দার, বরিশালের জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওয়ার্ড বিএনপির সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন, বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গোলাম মোস্তফা নান্না, ফরিদপুরের নগরকান্দার সোবহান এবং গাইবান্ধার ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস (২৩) ও ওয়ালিউল্লাহ (২৪), ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার এবং তার দুই সঙ্গী মুরাদ ও ফোরকান, মিজানের শ্যালক মিজান শিকদার এবং তার ভাতিজা সুমন, নজরুল ইসলাম বাছা, শ্রমিক হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আবদুল করিম হাওলাদার। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ পল্লবী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলাম।
কয়েকটি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, গত এক সপ্তাহে তিনজন ফিরে আসায় তারা এখন আশাবাদী হয়ে উঠছেন। যেকোনো সময় তারাও ফিরে আসবেন বলে আশা করছেন তারা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/279854