২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ২:১৮

আদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হজরত মুহাম্মদ (সা.)

-প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ

 
মানবজাতির শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (সা.), তিনি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষক নন। মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের শিক্ষক। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মুক্তির দূত হিসেবে। তিনি শুধু বাণী পৌঁছে দিয়েই তার দায়িত্ব পালন করেননি, নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করে আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। ব্যবহারিক বিজ্ঞানের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। দার্শনিক মনে করেন সকল বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল রাষ্ট্রদর্শন। কারণ রাষ্ট্রদর্শনের প্রভাব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল বিষয়কে প্রভাবিত করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ প্রেরিত আল কুরআনের রাষ্ট্রদর্শনের তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রচার করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তাঁর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই তিনি শুধু তাত্ত্বিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই নন, একজন আদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রনায়ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তাঁর জীবনের পর্যায়গুলো অত্যন্ত সাবধানে; অথচ সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন হতেন ঠিকই এবং উচ্ছন্নে যাওয়া মক্কা নগরীতে তার মিশন সফল করার জন্য তিনি ফিরে এসেছেন বার বার। মক্কানগরী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মভূমি হলেও ইসলাম তার পরিপূর্ণতা লাভ করেছে মদীনায়ই। হেরাগুহায় মহানবী (সা.) ছিলেন উপবাসী, সন্ন্যাসী ও সুফি সাধক। তারপর মদীনায় এসে তিনি হলেন ইসলামের বাণীবাহক।
 
মদীনায় এসে তিনি হলেন ইসলামের প্রবর্তক। ইসলামী আদর্শভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রধান। মদীনায়ই ইসলামী চেতনা পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও স্বচ্ছতর হলো। পবিত্র কুরআন শরীফেই রয়েছে, ‘আজ আমি আপনার দীনকে পূর্ণতা দান করলাম এবং আমার পক্ষ থেকে পূর্ণ রহমত আপনার ওপর নাজিল করলাম। আমি খুশি যে ইসলাম আপনার দীন। (মাদানি সূরা : কুরআন; আলিয়া ইজেতবেগোভিচ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও ইসলাম, ১৯৯৬, ৭৯)। মক্কায় নয়, মদীনায়ই ইসলামের সার্বিক সামাজিক ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়।
 
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হেরাগুহায় ধ্যানমগ্নতা, তারপর বাস্তবতার জগতে প্রত্যাবর্তন, এককথায় পারমার্থিকতা ও যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা ও কর্মনিষ্ঠার সমন্বয়- এই হলো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে তার পরিপূর্ণতা। এ যেন মানবজীবনের সারবত্তা। মনুষ্য জীবনের মতোই এর রয়েছে একদিকে ‘স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ’, যা এক মহাকবির মহাকাব্য এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সহজ, সরল ও আকর্ষণীয় গদ্য।
 
আজকের সভ্য পাশ্চাত্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করেলেও মদীনার কল্যাণ রাষ্ট্রের শান্তির সুবাতাস তারা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। খ্রিস্টবাদ কখনো একেশ্বরবাদে স্থির হয়নি। খ্রিস্টান গসপেলে (Trinity) তাই দেখা যায়, তিন সত্তার অবস্থান, ট্রিনিটি (Trinity)। খ্রিষ্টীয় তত্ত্বে ঈশ্বর হলেন পিতা। মা মেরী ও অন্যান্য সাধু বা সেইন্টরা খ্রিস্টবাদে দেবতুল্য। মুসলমানরা কিন্তু মহানবীকে শ্রদ্ধা করেন একজন পরিপূর্ণ মানবরূপে, কোনো ফেরেশতারূপে নয়। এইভাবে ইসলামী সংস্কৃতি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের মসজিদকে খ্রিস্টানদের গির্জা অথবা হিন্দুদের মন্দিরের সাথে তুলনা করলেই বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। মসজিদে দেখা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক মুক্ত ও উদার আবহ। গির্জায় দেখা যায় রহস্যময়তার এক পরিবেশ। মন্দিরে পাওয়া যায় রহস্যময়তার সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ বা বর্ণভিত্তিক কর্তৃত্ব এবং যাজকীয় প্রাধান্যের এক আবহাওয়া। মসজিদের অবস্থান সাধারণত কর্মস্থলে, কোনো বাজার বা বসতির কেন্দ্রে। মসজিদে নামাজ আদায়ের পর জাগতিক বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। গির্জা কিন্তু বাস্তবতার অনুষঙ্গ থেকে দূরে থাকতে চায়। আনুষ্ঠানিক নীরবতা, অন্ধকার অথবা অতীন্দ্রিয় জগতের অনুভব নির্মাণের প্রচেষ্টা এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। খ্রিস্টধর্মের মর্মবাণী অথবা গসপেলের (Trinity) লক্ষ্য শুধু ব্যক্তি, কিন্তু কুরআনের বাণী ব্যক্তিসমষ্টির জন্য।
 
গির্জার ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় এক ধরনের অভিজাততন্ত্র। ভাবগম্ভীর পরিবেশে যাজকীয় কর্তৃত্বের প্রকাশ। মসজিদে কিন্তু সাধারণ ও অসাধারণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র মূর্ত। ইসলামী আইনব্যবস্থায় ইজমা বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ জনগণের ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত, তার মাধ্যমে জনগণের অভিমতের প্রকাশ ঘটেছে ইসলামে। ইসলামে এভাবে শুধু যে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাই নয়, নতুন সভ্যতার পথও প্রশস্ত হয়েছে। সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী চিত্র হলো শিক্ষা। কুরআন শরীফের প্রথম আয়াতেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। তাছাড়া কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাঁর প্রতিনিধিরূপে উল্লেখ করেছেন। মানুষ কিন্তু বিশ্বময় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে শুধুমাত্র তার বিশেষ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে, বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে। তাই শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণ দু’টোই ইসলামে অবশ্য করণীয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘আমি দু’জনের বিষয়ে অসন্তুষ্ট : অজ্ঞ ভক্ত এবং নাস্তিক পণ্ডিত’ (Ralph waldo emerson. The conduct of life গ্রন্থে উদ্ধৃত)।
 
তিনি নিজে যাদের প্রশিক্ষিত করেছিলেন। তাঁর মহান সাহচর্যে থেকে যাঁরা শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছেন সেই সংস্কৃতিবান মানুষদের নিয়েই তিনি মদীনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর মক্কী জীবনের ১৩ বছর ছিল কঠিন এক পরীক্ষার সময়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিরাই রাসূল (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
তাঁর মদীনায় হিজরতের দুই বছর পর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনা এবং এর আশপাশের মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রকে নিয়ে রাসূল (সা.) একটি শান্তি চুক্তি করেন, যেটি ইসলামের ইতিহাসে; এমনকি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান ও মানবাধিকার সনদ, যা ইতিহাসে মদীনা সনদ নামে পরিচিত। এটি রচিত হয় মদীনা রাষ্ট্রের নানা ধর্মের মানুষদের শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য। এই লিখিত সনদটি প্রথমবারের মতো গোত্রভিত্তিক একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। প্রথমবারের মতো বিশ্বের বুকে একটি ভৌগোলিক জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নানা ধর্মের, নানা গোত্রের মানুষ মিলে এক জাতিতে পরিণত হয়। এমনকি আইন তৈরি এবং প্রণয়নের প্রাথমিক ধারণাও এখান থেকে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই সনদ শিখিয়েছে কীভাবে পাশাপাশি সহাবস্থানে থেকে সকল গোত্রের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা যায়। এই সংবিধান যাবতীয় মানবাধিকার, নারী অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক নিরাপত্তা, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করেছে। এটি মদীনাকে সব ধরনের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তির এবং নিরাপত্তার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রকারান্তরে রাসূল (সা.) একটি ইসলামী আদর্শভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রই ভিত্তি স্থাপন করেছেন মদীনায়। ১৯৮৬ সালে ড. হামিদুল্লাহ বিভিন্ন ইসলামিক দলিল-পত্রের সাহায্যে মদীনা সনদকে ৪৭টি ধারায় ভাগ করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার এবং বিচারক ড. মুহম্মদ তাহির আল কাদরী এ সনদ নিয়ে বিশদ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং আধুনিক সংবিধানগুলোর মতো করে সনদের বিভিন্ন ভাগের বিভিন্ন শিরোনাম দিয়েছেন এবং সংবিধানটিকে ৬৩টি আর্টিকেলে ভাগ করেছেন। ড. কাদরীর বইটির নাম হলো ‘মদীনা সনদের সাংবিধানিক বিশ্লেষণ’। ৬৩টি ধারাগুলো নিম্নরূপ-
 
আর্টিকেল ১ : সাংবিধানিক দলিল : এই সংবিধান আল্লাহর নবী রাসূল (সা.) (আল্লাহ তায়ালার হুকুমে) কর্তৃক প্রণীত।
 
আর্টিকেল ২ : সংবিধানের অধিভুক্ত পক্ষসমূহ : এই সংবিধানটি কুরাইশ মুসলিম, মদীনার নাগরিক, তাদের অধীনস্থ গোত্রসমূহ যারা রাজনৈতিকভাবে তাদের সাথে যুক্ত হবে এবং তাদের হয়ে যুদ্ধ করবে।
 
আর্টিকেল ৩ : সাংবিধানিক জাতীয়তা : উপরোল্লিখিত পক্ষসমূহ একটি সাংবিধানিক ঐক্যের ভিত্তিতে পরিচিত হবে যা অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ থেকে তাদের আলাদাভাবে পরিচিত করবে।
 
আর্টিকেল ৪ : রক্তমূল্য পরিশোধের পূর্ববর্তী গোত্রীয় আইন : মুহাজির কুরাইশদের জন্যও বৈধ এবং বলবৎকরণ মুহাজির কুরাইশগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ৫ : বনি আউফ গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি আউফ গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ৬ : বনি হারিস গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি হারিস গোত্রের মুহাজিরগণও আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ৭ : বনি সাঈদা গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি সাঈদা গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ৮ : বনি জুশাম গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি জুশাম গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ৯ : বনি নজর গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি নজর গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ১০ : বনি আমর গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি আমর গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ১১ : বনি নাবীত গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি নাবীত গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ১২ : বনি আউস গোত্রের জন্যও রক্তমূল্যের পূর্বের আইন বলবৎকরণ : বনি আউস গোত্রের মুহাজিরগণ আগেকার বিধিবিধান মোতাবেক তাদের গোত্রের জন্য দায়বদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে রক্তঋণ পরিশোধ করবে এবং প্রতিটি পক্ষই মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করে নিবে এবং বিশ্বাসীদের মাঝে যাবতীয় লেনদেন হবে বিদ্যমান আইন মোতাবেক এবং ইনসাফের ভিত্তিতে।
 
আর্টিকেল ১৩ : আইন ও সুবিচারের সমতা সকল গোত্রের জন্য প্রযোজ্য : সকল গোত্রকে বন্দীমুক্তি দেয়ার অধিকার দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের প্রতি আইনের সমতা এবং সুবিচার নিশ্চিত করা হলো।
 
আর্টিকেল ১৪ : আইনে শিথিলতা নিষিদ্ধ : বিশ্বাসীরা নিজেদের মাঝে কোনো ঋণগ্রস্থ রাখবে না, সাধ্যমতো তাকে মুক্তিপণ পরিশোধ করতে সহায়তা করবে।
আর্টিকেল ১৫ : অন্যায় পক্ষপাত নিষিদ্ধ : কোনো বিশ্বাসী অন্য কোন বিশ্বাসীর সাথে তার মতামত না নিয়ে কোনো অ্যালায়েন্স করবে না।
 
আর্টিকেল ১৬ : অবিচার, নিষ্ঠুরতা এবং আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ : মদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরোধিতাকারী বা জোরপূর্বক কোনো কিছু জবরদখল করার চেষ্টারত বা বিশ্বাসীদের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’ এদের বিরুদ্ধে সকল বিশ্বাসী একসাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, যদি সেই বিপ্লবী বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী তাদের কারো সন্তানও হয়ে থাকে।
 
আর্টিকেল ১৭ : একজন মুসলিম কর্তৃক আরেকজন মুসলিম হত্যা করা নিষিদ্ধ : একজন অবিশ্বাসীর জন্য কোন মুসলিম অপর কোনো মুসলিমকে হত্যা করবে না; এমনকি কোন বিশ্বাসীর বিরুদ্ধে কোনো অবিশ্বাসীকে সাহায্যও করবে না।
 
আর্টিকেল ১৮ : সকল মুসলিমের জন্য জানের নিরাপত্তার সমঅধিকারের নিশ্চয়তা : আল্লাহ কর্তৃক সবার নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সংবিধান সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, এর জন্যে সকল বিশ্বাসীকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বিনয়ী হতে হবে (সকল বিশ্বাসীর জন্যই এটা বাধ্যতামূলক)।
 
আর্টিকেল ১৯ : অন্যান্য সাংবিধানিক কমিউনিটির চেয়ে মুসলিমদের আলাদা সাংবিধানিক পরিচয় : বিশ্বাসীরা একে অপরকে সাহায্য করবে বহির্বিশ্বের বিপরীতে।
 
আর্টিকেল ২০ : অমুসলিম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী (ইহুদি)-এর জন্যও জীবনের নিরাপত্তার সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ (মুসলিমদের মতো) : রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল একজন ইহুদির জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হলো যে পর্যন্ত না তিনি বিশ্বাসীদের জন্য ক্ষতিকর কিছু না করেন বা বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে বাইরের কাউকে সাহায্য না করেন।
 
আর্টিকেল ২১ : সমতা এবং ইনসাফের ভিত্তিতে সকল মুসলিমের জন্য শান্তি এবং নিরাপত্তার বিধান : বিশ্বাসী কর্তৃক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সবার জন্য সমান। যখন আল্লাহর রাস্তায় কোন জিহাদের প্রয়োজন হবে কোন বিশ্বাসী শত্রুপক্ষের সাথে আলাদাভাবে কোন চুক্তিতে যাবে না, যদি না সেটা সকল বিশ্বাসীদের জন্য সমতা এবং নায্যতা প্রতিষ্ঠা করে।
 
আর্টিকেল ২২ : যুদ্ধের সহযোগী পক্ষগুলোর জন্য ছাড় : যুদ্ধের প্রতিটি পক্ষের জন্যই যুদ্ধের যাবতীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ ছাড়।
 
আর্টিকেল ২৩ : আল্লাহর রাস্তায় হতাহতের বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিশোধ : আল্লাহর রাস্তায় নিহতদের প্রতিশোধ নিতে বিশ্বাসীরা একে অপরকে সাহায্য করবে।
 
আর্টিকেল ২৪ : ইসলাম জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিধান : তাকওয়াসম্পন্ন বিশ্বাসীদের জন্য উৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে সঠিক জীবন পদ্ধতি ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে।
 
আর্টিকেল ২৫ : শত্রুপক্ষকে জীবনের এবং সম্পদের নিরাপত্তা দেয়া নিষেধ : কোন পৌত্তলিকের জানের এবং সম্পদের নিরাপত্তা কুরাইশদের কাছে নেই, যেহেতু তারা মদীনা রাষ্ট্রের শত্রু। এমনকি কোন বিশ্বাসীর বিরুদ্ধে তাদের সহায়তাও প্রদান করা হবে না।
 
আর্টিকেল ২৬ : মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ : যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুসলিমকে হত্যা করে এটা সত্য প্রমাণিত হলে সেই হত্যাকারীকেও হত্যা করা হবে। যদি না নিহতের আত্মীয়-স্বজন জানের বদলা হিসেবে রক্তমূল্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। বিশ্বাসীরা একযোগে সেই হত্যাকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, হত্যাকারীর বিরোধিতা করা ছাড়া বিশ্বাসীদের আর কোন অবস্থান হতে পারবে না।
 
আর্টিকেল ২৭ : সংবিধানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বা ধ্বংসকারীদের ক্ষেত্রে কোন সুরক্ষা বা ছাড় নেই : যারা বিশ্বাসী, এক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং পরকালে বিশ্বাস করে এবং এই দলিলের সব ধারার সাথে সম্মতি জানিয়েছে তারা এই সংবিধানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বা এই সংবিধান অকার্যকর করার সাথে যুক্ত এমন কাউকে কোনরূপ সুরক্ষা বা ছাড় দেবে না। যারা এমনটি করবে, কেয়ামতের দিন তাদের জন্য রইলো আল্লাহর অভিশাপ এবং প্রচ- ক্রোধ। এমনকি কেয়ামতে দিন ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের কোনকিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না।
 
আর্টিকেল ২৮ : যেকোন বিষয়ে দ্বিমত বা বিতর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) : যখন তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিবে, তখন সেটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) কাছে সেটি পেশ করবে। যেহেতু সকল বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়সালা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)-ই দেবেন।
 
আর্টিকেল ২৯ : অমুসলিম মানে ইহুদিগণ যুদ্ধের ব্যয়ভার সমানুপাতিক হারে বহন করবে : ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ইহুদিগণ যতক্ষণ তাদের সাথে একসাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, সমানুপাতিক হারে যুদ্ধের ব্যয়ভার এবং দায়দায়িত্ব বহন করবে।
 
আর্টিকেল ৩০ : সকল মুসলিম এবং অমুসলিমদের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা : বনি আউফ গোত্রের ইহুদিগণ বিশ্বাসীদের সাথে মিলে একটি কমিউনিটি হিসেবে বিবেচিত হবে। মুসলিমদের সাথে সাথে তাদেরও পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। তাদের এবং তাদের সহযোগী সবার জন্যই এই অধিকার সুনিশ্চিত করা হলো, তাদের ছাড়া যারা অন্যের ওপর বলপ্রয়োগকারী অপরাধী এবং যারা এই চুক্তি ভঙ্গকারী। এভাবে তারা শুধুমাত্র নিজেদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
 
আর্টিকেল ৩১ : বনি নজর গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি নজর গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে।
 
আর্টিকেল ৩২ : বনি হারিস গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি হারিস গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে।
 
আর্টিকেল ৩৩ : বনি সাঈদা গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি সাঈদা গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে।
 
আর্টিকেল ৩৪ : বনি জুশাম গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি জুশাম গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে।
 
আর্টিকেল ৩৫ : বনি আউস গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি আউস গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে।
 
আর্টিকেল ৩৬ : বনি থা’লাবা গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি থা’লাবা গোত্রও একইরকম অধিকার ভোগ করবে, তারা ছাড়া যারা অন্যের ওপর বলপ্রয়োগকারী অপরাধী এবং যারা এই চুক্তি ভঙ্গকারী। এভাবে তারা শুধুমাত্র নিজেদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
 
আর্টিকেল ৩৭ : বনি থা’লাবার উপগোত্র জাফনার ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : জাফনা, থা’লাবা গোত্রের একটি শাখা তারাও থা’লাবা গোত্রের মতো একইরকম অধিকার ভোগ করবে
 
আর্টিকেল ৩৮ : বনি শুতাইবা গোত্রের ইহুদিগণেরও বনি আউফ গোত্রের মতো সমান অধিকার : বনি আউফের মতো বনি শুতাইবা গোত্রের ইহুদিগণও একইরকম অধিকার ভোগ করবে। তারা এই সংবিধানের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রদর্শন করবে এবং এর কোন একটি ধারাও ভঙ্গ করবে না।
 
আর্টিকেল ৩৯ : থা’লাবা গোত্রের সকল সহযোগীদের অধিকারের সমতা : বনি থা’লাবার জন্য যে অধিকার, তার সহযোগী সব গোত্রের জন্যও সমঅধিকার নিশ্চিত করা হলো।
 
আর্টিকেল ৪০ : ইহুদি সকল শাখার জন্য অধিকারের সমতা : ইহুদিদের প্রতি যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তাদের সকল শাখার জন্যও একই প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো।
আর্টিকেল ৪১ : সশস্ত্র যুদ্ধে যাবার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং আদেশ দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর : আল্লাহর রাসূলের (সা.) পূর্বানুমতি ছাড়া কেউ সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে পারবে না। যেহেতু যুদ্ধের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার অথরিটি কেবলমাত্র রাসূল (সা.)।
 
আর্টিকেল ৪২ : প্রতিশোধের ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম নেই : কেউ কোন যৌক্তিক প্রতিশোধ বা খুনের বদলা নিতে চাইলে সেখানে কোনরূপ বাধা প্রদান করা হবে না।
 
আর্টিকেল ৪৩ : বেআইনি হত্যার দায় দায়িত্ব : কেউ যদি বেআইনিভাবে কাউকে খুন করে তবে সে এবং তার পরিবার এর জন্য দায়ী হবে, তবে সে যদি কোন নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী কাউকে খুন করে সেক্ষেত্রে ছাড় পেতে পারে। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এই সনদের আনুগত্যকারীদের সাথে আছেন।
 
আর্টিকেল ৪৪ : পৃথকভাবে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা : মুসলিম এবং ইহুদিগণ পৃথকভাবে নিজ নিজ যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।
 
আর্টিকেল ৪৫ : যুদ্ধের সময় একে অপরকে সহায়তা করা অবশ্য কর্তব্য : এই সনদে স্বাক্ষরকারীদের সাথে যারা যুদ্ধরত তাদের বিরুদ্ধে সকলের পারস্পরিক সহায়তা করা অবশ্যকর্তব্য।
 
আর্টিকেল ৪৬ : পারস্পরিক আলোচনা এবং সম্মানজনক লেনদেন : এই চুক্তিনামায় স্বাক্ষরদানকারী প্রতিটি পক্ষ নিজেদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া বজায় রাখবে এবং সম্মানজনকভাবে লেনদেন করবে এবং নিজেদের মাঝে করা সকল প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে।
 
আর্টিকেল ৪৭ : বিশ্বাসঘাতকতা নিষিদ্ধ এবং নিপীড়িতদের সহযোগিতা প্রদান : কেউ মিত্রপক্ষের জন্য কোন চুক্তি ভঙ্গ করবে না এবং নিপীড়িতদের সাহায্য করা হবে।
 
আর্টিকেল ৪৮ : ইহুদিগণ (অমুসলিম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী) যুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রের প্রতি আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়াবে : মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিরাও যুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রকে দেয়া আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়াবে।
 
আর্টিকেল ৪৯ : রাষ্ট্রে বিদ্যমান বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ এবং রক্তপাত নিষিদ্ধ : ইয়াসরিব উপত্যকা পবিত্র ভূমি, সেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে যুদ্ধ এবং রক্তপাত নিষিদ্ধ করা হলো।
 
আর্টিকেল ৫০ : সনদের অধীনে আশ্রয় নেয়া জনগণের সমভাবে জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা : কোন ব্যক্তিকে মদীনায় আশ্রয় দেয়া হলে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ক্ষতিকর কিছু করছে বা বিশ্বাসঘাতকতা করছে ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারও সমান অধিকার।
 
আর্টিকেল ৫১ : নারীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে আইন : একজন নারীকে তার পরিবারের সম্মতি ছাড়া আশ্রয় দেয়া হবে না।
 
আর্টিকেল ৫২ : কোন মতবিরোধ সংঘাতের দিকে পৌঁছালে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল (সা.)-ই হবেন
 
এর চূড়ান্ত ফায়সালাকারী : যখনই এই সনদে স্বাক্ষরকারী দলসমূহের মধ্যে কোন মতপার্থক্য চরমে পৌঁছালে, সংঘাতের দিকে যাবার আশঙ্কা তৈরি হলে সেটার বিচারের ভার আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) ওপর ন্যস্ত করা হবে। রাসূল (সা.)-ই চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ মানদ-ের সঠিক সমাধান দিবেন। এই সংবিধানের ওপর আস্থাশীল বিশ্বাসীদের যারা এই সংবিধানের নীতিমালাসমূহ সঠিকভাবে পালনে সচেষ্ট তাদের যাবতীয় দায়দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার।
 
আর্টিকেল ৫৩ : শত্রুরাষ্ট্রের কাউকে বা তাদের কোন মিত্রকে কোন আশ্রয় নয় : কুরাইশ এবং তার মিত্রদের কোনো আশ্রয় দেয়া হবে না।
 
আর্টিকেল ৫৪ : রাষ্ট্রের ওপর কোন আঘাত আসলে সম্মিলিত প্রতিরোধ : বাহির থেকে মদীনা রাষ্ট্রের ওপর কোন আঘাত আসলে মুসলিম এবং ইহুদিগণ সম্মিলিতভাবে সেটা প্রতিরোধ করবে।
 
আর্টিকেল ৫৫ : প্রতিটি মিত্র গোত্রের জন্য শান্তিচুক্তি মেনে চলা অবশ্যকর্তব্য : ইহুদিদের কোন শান্তিচুক্তিতে আহ্বান জানানো হলে এটা তাদের দায়িত্ব যে তারা সেটি পালন করবে এবং এর সাথে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধভাবে যুক্ত থাকবে। একইভাবে মুসলিমদের কোন শান্তিচুক্তিতে আহ্বান জানানো হলে এটা তাদের দায়িত্ব যে তারা সেটি পালন করবে এবং এর সাথে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধভাবে যুক্ত থাকবে।
 
আর্টিকেল ৫৬ : কোন চুক্তিই ধর্মীয় চর্চা থেকে কাউকে বিরত রাখবে না বা ধর্মপালনে বাধা দিবে না : (যদিও মুসলিমদের কোন শান্তিচুক্তিতে আহ্বান জানানো হলে এটা তাদের দায়িত্ব যে তারা সেটি পালন করবে এবং এর সাথে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধভাবে যুক্ত থাকবে।) তবে কোনো চুক্তিই তাদের আল্লাহর পথে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই থেকে বিরত করতে পারবে না।
 
আর্টিকেল ৫৭ : প্রতিটি মিত্রপক্ষ তাদের নিজ নিজ সম্মুখভাগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে : চুক্তিতে স্বাক্ষররত প্রতিটি পক্ষ তাদের নিজ নিজ সম্মুখভাগের সমরনীতি নিজেরাই নির্ধারণ করবে এবং কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে সে ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে।
 
আর্টিকেল ৫৮ : স্বাক্ষরকারী প্রত্যেকটি দলের জন্যই মূল সাংবিধানিক মর্যাদা সমান : আউস গোত্র এবং তাদের মিত্র সকল ইহুদিগণ এই সংবিধানে স্বাক্ষরকারী অন্য দলগুলোর মতো সমানভাবে সাংবিধানিক মর্যাদা পাবে এই শর্তে যে তারা নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
 
আর্টিকেল ৫৯ : সংবিধান অবমাননা করার কোন অধিকার কোন পক্ষের নেই : বিদ্যমান কোন দলেরই সংবিধান অবমাননা করার কোন অধিকার নেই। কেউ যদি কোন অপরাধ করে তাহলে সে নিজেই এর জন্য দায়ী।
 
আর্টিকেল ৬০ : সংবিধানের প্রতি আনুগত্যশীলদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল : যারা বিশ্বস্ততার সাথে এই সংবিধানের প্রতি আনুগত্যশীল থাকবে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি সবসময়ে সদয় থাকবেন।
 
আর্টিকেল ৬১ : কোন বিশ্বাসঘাতক বা বলপ্রয়োগকারীর জন্য এই সংবিধানের অধীনে কোনো আশ্রয় নেই : এই মর্মে বলা হচ্ছে যে এই সংবিধান কোন বিশ্বাসঘাতক বা অন্যায়ভাবে বলপ্রয়োগকারীকে কোন সুরক্ষা দিবে না।
 
আর্টিকেল ৬২ : সকল শান্তিপূর্ণ নাগরিক নিরাপদ এবং সুরক্ষিত : যারা যুদ্ধে যাবে বা যারা মদীনায় অবস্থান করবে সবার জন্যই নিরাপত্তা, শুধুমাত্র তাদের ছাড়া যারা গোলযোগ সৃষ্টি করছে এবং সংবিধান মেনে চলছে না।
 
আর্টিকেল ৬৩ : সংবিধানের প্রতি আনুগত্যশীল : মদীনার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) হলেন রক্ষাকর্তা এ মর্মে ঘোষণা করা হচ্ছে যে আল্লাহ এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল (সা.), মদীনার সুনাগরিক এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের রক্ষাকর্তা।
 
এ চুক্তির মধ্য দিয়ে মদীনার নানা গোত্রের, ধর্মের মানুষের মধ্যে একটি শান্তি ও নিরাপত্তাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল এবং এরপর থেকে ইসলামের মূল জয় শুরু হয়, কুরাইশদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী জয় লাভ করতে থাকে। এ চুক্তির ছয় বছর পর ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কুরাইশদের সাথে রাসূল (সা.)-এর বাহিনীর যে শান্তিচুক্তি হয় সেটির নাম ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’। সেখানে কুরাইশরা রাসূল (সা.)-কে আল্লাহর নবী হিসেবে মানতে চায়নি, তবুও রাসূল (সা.) শুধু তাঁর পিতৃপ্রদত্ত পূর্বনামেই চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন, মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন। আর এই সূত্র ধরেই আরো দুই বছর পর মুসলিমরা অর্জন করেছে তাদের চূড়ান্ত বিজয়। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর রাসূল (সা.) এবং তাঁর বাহিনী মক্কা জয় করেন। সেখানে দীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পবিত্র কাবাঘরের সকল মূর্তি অপসারিত হয়।
 
ইসলামের মৌল ভিত্তি যে একত্ববাদ তা যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যোগ্য লোক তৈরির শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়েছে, সেই ঐক্যানুভূতির প্রতিকৃতিও রূপ পেয়েছে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাক্ষেত্রে বিশ্বময় আজ যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিশেষ করে তথ্য প্রবাহের অবাধ গতির প্রেক্ষাপটে, গণতান্ত্রিকতার বৈপ্লবিক সম্প্রসারণের একালে, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায় বটে, কিন্তু তা আংশিক।
 
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইন-চিকিৎসা, অর্থনীতি, পরিকল্পনা, যুক্তিবিদ্যা-প্রকৌশল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা গতিশীল হলেও ধর্ম ও নীতিশান্ত্র, দর্শন ও সৃষ্টিতত্ত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অপরিণত ও অপূর্ণ। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা এক্ষেত্রে এখনো পথিকৃৎ, এখনো দিশারিতুল্য, উজ্জ্বল দীপশিখার মতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ক্ষেত্রকে নৈতিকতার আবরণমুক্ত করে অগ্রসরমান মানবগোষ্ঠী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তা যে কোনো মুহূর্তে সমগ্র মানবসমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তখন কিন্তু বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে একমাত্র উজ্জ্বল আলোকরশ্মি। এই শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষদের নিয়েই হজরত মুহাম্মদ (সা.) সকল জাতি ধর্মের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে এক জাতিকে পরিণত করেছিলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ প্রেরিত রাসূল এবং একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার পরও তিনিই প্রথম লিখিতভাবে ঘোষিত করেছিলেন, ‘মদীনা রাষ্ট্রের উম্মাহ শুধু মুসলমানদের নয়, নয় কুরাইশদের অথবা মুহাজির ও আনসারদের। এই উম্মাহ সকলের। ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের। যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে, কিন্তু জাতি হিসেবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সকলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে সকলেই কৃতসঙ্কল্প।’
 
লেখক : প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
কার্টেসীঃ সাপ্তাহিক সোনার বাংলা সীরাত সংখ্যা।