২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:১৬

স্বস্তি নেই চালের দামে

ভরা মৌসুমে হাট-বাজারে ধানের প্রচুর আমদানি

দেশের খাদ্য ভান্ডার খ্যাত উত্তরাঞ্চলে এবার আমন উৎপাদন মোটামুটি হলেও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক রয়ে গেছে। কোথাও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবাদ বেশী হয়েছে। ফলনও হয়েছে ভাল। আবার বন্যা-ঝড়ো হাওয়া পোকা মাকড়ের আক্রমন ধানের ফলনে বিপর্যয়ও ঘটেছে। এতকিছুর পরও মোট আবাদ খুব একটা মন্দ নয়। কিন্তু আমনের ভর মওসুমেও চালের বাজার চড়া। সাধারনত এসময় বাজার থাকে সহনীয়। চারিদিকে এত ধান তারপরও চালের দাম বাড়তির দিকে। এনিয়ে অস্বস্তিতে মানুষ। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মতে বাংলাদেশে আমন ও বোরো মওসুমে যে পরিমান জমিতে ধানের চাষ হয়ে থাকে তার প্রায় অর্ধেক হয় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলাতে। এ বছর তাদের হিসেব মতে রাজশাহী বিভাগের চার জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৫৩ হেক্টর। আর উৎপাদন ধরা হয়েছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ৭০ মে:টন চাল। বাস্তবে আবাদ হয়েছে হেক্টর ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮৪ হেক্টরে। চাল উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৩২ হাজার ৪৫১ মে:টন। রংপুর অঞ্চলে রংপুর, নিলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪ শত ৭৭ হেক্টর। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ লাখ ৫৯ হাজার ২শ ২৪ মে:টন। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ধান উৎপাদন হয় প্রায় ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৯ মে:টন। দিনাজপুরের তিন জেলা পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫৫ হেক্টর। ফলন ধরা হয়েছিল ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৫শ ৮ মে:টন। অর্জন হয়েছে ১৫ লাখ ২৫ মে:টন। বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৫৯ হাজার ১শ ৫ হেক্টর। বাস্তবে আবাদ হয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪শ’ ৮৭ হেক্টরে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ হাজার হেক্টর কম। ফলন হয়েছে ১১ লাখ ৪ হাজার ৭শ’ ৯ মে:টন।

সর্বত্র আমন কাটাই মাড়াই শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। সব ধান এখন গেরস্তের গোলায়। আড়তে মজুদদার আর মিলারদের ঘরে। অল্প কিছু রয়েছে ছোট ছোট কৃষকের কাছে। আমনের ঝাড়াই মাড়াই শেষ হলেও হাটে বাজারে তেমন ভাবে ধান আসছে না। ভর মওসুমে ধানের হাটগুলোয় যতটা থাকার কথা ততটা পাওয়া যাচ্ছেনা। শুরুতে দাম সাড়ে আটশো দিয়ে শুরু হলেও এখন ক্ষেত্র বিশেষে এগারো হতে বারোশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রধান ধান চালের মোকাম হিসেবে পরিচিত ঈশ্বরদী, সান্তাহার , নওগাঁ , দিনাজপুর , মোকামতলা , নন্দীগ্রামের পাইকারী বাজারেই এখন আমন মওশুমের মোটা ধান বিআর ১১ বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ টাকা মন দরে । বিআর ২৮, ২৯ ও ৪৯ জাতের চিকন ধানের মুল্য ১২শ’ টাকা । নাজির শাইল , জিরাশাইল ও কাটারীভোগের ধানের দাম আরও বেশি ।

ডিসেম্বরের শুরুতে সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ধান চালের সংগ্রহ অভিযান শুরু করলেও উত্তরাঞ্চলে এখনো তেমন সাড়া মেলেনি। আমনের ভর মওসুমে চালের বাজার চড়া। যেখানে নতুন ধান আসার পর দাম কমার কথা সেখানে হাটে উল্টো শ্রোত। চালের দাম বাড়ছে। চিকন চালের দাম ষাট টাকা কেজির উপরে। আর মোটা চালের দাম ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি। আমনের ভর মওসুমে পাইকারী ও খুচরো বাজারে চালের দাম বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলছেন এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। ধানের বাজার এখন চড়া হলেও এর সুফল প্রান্তির চাষীদের কপালে জোটেনি। শুরুতে আবহাওয়া বিরুপ হবার কারনে কোথাও কোথাও দুবার করে চারা রোপন করতে হয়েছে। ফলে আবাদের খরচও বেশী হয়েছে। আমাদের ব্যুরো অফিস ও জেলা প্রতিনিধিরা মাঠ পর্য্যায়ে আমনের খুটিনাটি তুলে ধরেছেন।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, এবার বরেন্দ্র অঞ্চলে (চার জেলায় রাজশাহী-নওগা-নাটোর চপাইনবাবগঞ্জে) আবাদ হয় সাড়ে তিনলাখ হেক্টরের বেশী জমিতে। রাজশাহীতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল সত্তর হাজার হেক্টর জমি কিন্তু বাস্তবে আবাদ হয় ৭৩ হাজার হেক্টরে। আধা পাকা অবস্থায় বর্ষন আর বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় বারো হাজার হেক্টর জমির ফসল। এরপর শেষ মুহুর্তে বিরুপ আবহাওয়া ও ঝড়ো বাতাস অনেক ক্ষেতের ধান শুয়ে যায়। ফলে এসব ধানে চিটা হয় বেশী। যাতে ফলন বিপর্যয় ঘটে। কৃষি বিভাগ বিঘা প্রতি ১৭ মন ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করলে কোথাও এরচেয়ে দু’তিন মন বেশী আবার কোথাও তিন চারমন কম ফলন হয়েছে।

বগুড়া ব্যুরো থেকে মহসিন রাজু জানায়, বগুড়ায় চলতি মওশুমে কৃষি বিভাগ ১ লাখ ৯০ হাজার জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহন করা হলেও চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টরে। এছাড়াও ৫ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন।
অন্যদিকে বগুড়ার খাদ্য বিভাগ চলতি ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ৩২ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে খুব সামান্য পরিমানে চাল সংগ্রহে সমর্থ হয়েছে। কতটুকু চাল চাল সংগ্রহ হয়েছে মর্মে জানতে চাইলে বগুড়ার খাদ্য বিভাগের সুত্র বলেছে, তা’ চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম । খাদ্য বিভাগের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা বলেছেন , বাজারে আমন ধানের যে দাম তাতে ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেকেই চাল সরবরাহ তরতে পারবেনা । তাদের মতে বগুড়ায় সরকারি ভাবে চাল সংগ্রহ পরিস্থিতি হতাশা জনক।
ভুক্তভোগী ক্রেতারা বলছেন, বগুড়ার হাট বাজারে মোটা চাল ৪৬ / ৪৯ ও মাঝারী মানের চিকন চাল ৫৫ / ৫৬ এবং পাইজাম , নাজির শাইল ও কাটারি জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে । কয়েকজন আমদানীকারক ভরা আমন মওশুমে চালের দাম বাড়ার কারণ ব্যাক্ষ্যা করে বলেছেন , এবার ভারতের পশ্চিম বঙ্গেও বাংলাদেশেরই অনুরুপ প্রকৃতির বৈরী অচরনের কারনে আমন ফসলের সমুহ ক্ষতি হয়েছে। ফলে সীমান্ত পেরিয়ে চোরাচালান হয়েও চাল ঢুঁকছেনা । আমদানীকারকরা এলসি খুলতে গেলে মওকা বুঝে ভারতীয় রফতানীকারকরা বাড়িয়ে দিচ্ছে চালের রফতানি মুল্য । ফলে কোনো ভাবেই আপাতত উত্তরের চালের বাজারে কোনোই সুখবরের সম্ভাবনা নেই আপাতত ।

রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানায়, চলতি বছর রংপুর অঞ্চলে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ করা হয়। এ বছর এ অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪’শ ৭৭ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করায়। এসব জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রায় ১৪ লাখ ৫৯ হাজার ২’শ ২৪ মেট্রিক টন। বন্যায় বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হলেও রংপুর অঞ্চলে আমনের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। কিছুটা ক্ষতি হয়েছে রবিশস্য এবং মাছ চাষে। বানের পানিতে ভেসে আসা পলি আমন চাষের জন্য আশির্বাদ বয়ে আনে। বানের পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের চাষীরা রবিশস্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমনের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। সে কারনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমনের চাষ করেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এ কারনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ধান উৎপাদন হয় প্রায় ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৯ মেট্রিক টনে। ফলন ভালো এবং দামও ভালো হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, দিনাজপুরে শুরুতে রোপা আমন চাষ বন্যার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অধিকাংশ এলাকায় দুবার করে চারা রোপন করতে গিয়ে আবাদ খরচ হয়েছে দ্বিগুন। এবার দিনাজপুর জেলায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে। আর এ থেকে চাল আকারে আমনের উৎপাদন লক্ষ্য ছিল আটলাখ মে:টন। আগাম জাতের ব্রি ধান আবাদ করে ভাল পাওয়া যায় হেক্টর প্রতি চাল আকারে এ দশমিক ৬৬ মে:টন। এমন ভাল ফলনে কৃষক খুশী।

পাবনা থেকে মুরশাদ সুবহানী জানায়, পাবনা জেলায় এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৯ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমিতে। বাস্তবে আবাদ হয় ৫২ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার ৮৭ হেক্টরে। এখানে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তিনদশমিক ছয় মেট্রিকটন। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া যায় প্রতি হেক্টরে চার মে:টন। বৈরী আবহাওয়ার কারনে এখানে ফলন বিপর্যয়ের আশংকা করা হলেও তা হয়নি। বরং বেশী হয়েছে। ফলে উৎপাকরা খুশী। তবে উৎপাদন খরচটা বেশী হওয়ায় লাভের মুখ খুব একটা দেখেনি উৎপাদকরা। তাছাড়া ফড়িয়ারা ধানের হাট বাজার নিয়ন্ত্রন করায় কৃষক নায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে আমনের ভাল ফলনের কুষকের মুখে হাসি ¤øান হয়ে গেছে।

নওগা থেকে এমদাদুল হক সুমন জানায়, রাজশাহী অঞ্চেলের সবচেয়ে বেশী ধান উৎপাদনকারী এলাকা নওগা জেলা। এবারো এখানে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা দুইলাখ একশো চল্লিশ হেক্টর জমিতে। কিন্তু বন্যা হানা দেয়ায় প্রায় সাড়ে আটত্রিশ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে আবাদের পরিমান দাড়ায় একলাখ বাষট্টি হাজার হেক্টর জমিতে। প্রতিবিঘা জমিতে ধান উৎপাদনের মাত্রা ধরা হয় পনের মন। যা চাল আকারে দশ মন। বিরুপ প্রকৃতি মোকাবেলা করে এখানে ধান উৎপাদন করলেও শেষ পর্যন্ত ফলন বিপর্যয় কিন্তু ছাড়েনি। গতবছর সর্বনি¤œ আঠারো থেকে বাইশ মন পর্যন্ত হয়েছিল। এবার সেখানে পাওয়া পনের ষোল মন। এদিকে এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশী হয়েছে। শুরুতে ধান বিক্রি হয়েছে মনপ্রতি সাড়ে আটশো হতে নয়শো টাকার মধ্যে। উৎপাদকদের অভিমত ধানের দাম যদি মনপ্রতি হাজার টাকার উপরে থাকে তবে হয়তো ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যাবে।

নাটোর থেকে আজিজুল হক টুকু জানান, নাটোর রোপা আমনের ভাল ফলন হয়েছে। বান বর্ষন তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। এবার রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৫ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে। আর এ থেকে ধানের উৎপাদন ধরা হয় ২ লাখ ৪৯ হাজার মে:টন। বাস্তবে আবাদ হয় ৫৬ হাজার ৭৫৬ হেক্টর জমিতে। আর এ থেকে ধান পাওয়া যায় ২ লাখ ৫৭ হাজার মে:টন। আর হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন হয়েছে ৪ দশমিক ৫৪ মে:টন। সব মিলিয়ে এবার আমন আবাদ করে নাটোরের কৃষক কিছুটা হলেও লাভবান হয়েছে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/109837