২১ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৪

প্রশ্নপত্র ফাঁস নাকি জাতির সর্বনাশ

প্রশ্ন ফাঁসের মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থা। গোটা দেশ। ভাবতেই অবাক লাগে, এই দেশে এখন প্রথম শ্রেণীর প্রশ্নপত্র পর্যন্ত ফাঁস হয়। অবাক লাগে এই ফাঁসে জড়িত বড় বড় ‘হোমরাচোমরা’ কর্মকর্তা। এমনকি জাতি গঠনে যাদের অবদান বেশি সেই শিক্ষকরা পর্যন্ত এই অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি এখন জাতির অস্তিত্ব ধরে টান দিয়েছে। ধ্বংস করে ফেলছে শিক্ষাব্যবস্থা, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শিক অবস্থান। তাহলে কোথায় চলেছি আমরা?

সর্বজনীন মৌলিক মানবাধিকারগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। আর এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারই আজ আমাদের দেশে বিপন্ন। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে যখন এই অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে সুসংহত ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তখন আমরা সেটিকে ভূলুণ্ঠিত ও পদদলিত করছি। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অপরিসীম নৈরাজ্য চলছে তা দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায়। শিক্ষা নিয়ে সর্বত্রই চলছে ‘আত্মহননের মহোৎসব!’ আমরা বুঝে না-বুঝে, জেনে না-জেনে মেতে উঠেছি সেই মহোৎসবে। এজন্যই বোধকরি বাঙালি চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী নীরদ সি. চৌধুরী এই জাতিকে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। জানি না শিক্ষা নিয়ে স্বাধীন দেশে বাঙালির আত্মহননের এ মহোৎসবকে তিনি কীভাবে অভিহিত করতেন!

বলা হয়, ‘স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, সংক্রামক হচ্ছে অসুখ’- আজ সেই অসুস্থতায় সংক্রমিত শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সবাই। আজ শিক্ষার ‘সর্বাঙ্গে ঘা, ওষুধ দেব কোথা’- এমনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা আমাদের। শিক্ষামন্ত্রী দুষছেন ‘কিছুসংখ্যক শিক্ষক’কে, দুদক দুষছে শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের। কোচিং সেন্টার কোচিং দিচ্ছে নকল করার কৌশল, বিক্রি করছে প্রশ্ন। সেগুলো তারা কিনে আনছে অথবা সংগ্রহ করছে নানা সূত্র থেকে। প্রশ্নপত্র বিক্রির দোকান খুলে বসা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের ওপর। তারা এখন রীতিমতো উদভ্রান্ত! বই নয়, শিক্ষা নয়- তারা ছুটছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে। আর এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন একশ্রেণীর অভিভাবকও- ‘সত্যিই সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!’
এমনও দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণীর পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর লিখছেন অভিভাবকরা, পরীক্ষার্থীদের হয়ে হলের বাইরে। হলের ভেতরে যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তারা প্রতীক্ষায় আছে, কখন আসবে সেই খাতা। বাইরে থেকে লেখা হয়ে আসা খাতা জমা দিয়ে তারা বীরদর্পে বেরিয়ে আসবে পরীক্ষার হল থেকে। অভাবনীয় এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হলে তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে মন্তব্য করেছেন, ‘এর চেয়ে সন্তানদের মুখে বিষ তুলে দিয়ে তাদের মেরে ফেলা শ্রেয়।’ আজ গোটা জাতির মুখে এভাবেই তুলে দেয়া হচ্ছে সেঁকো বিষ- যেটা নীরবে ধ্বংস করে ফেলছে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা, মনন, নৈতিকতা এবং বড় হওয়ার স্বপ্নগুলো। আমরা এমনই অন্ধ যে, সেটা দেখেও দেখতে পাচ্ছি না, জেনেও উপলব্ধি করতে পারছি না।

নৈরাজ্য কতদূর বিস্তৃত হলে এমনটি সম্ভব যে, প্রশ্নফাঁসের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয় ১৪০টি স্কুলের কর্তৃপক্ষ! বেতাগীতে সেটা ঘটেছে। ফেসবুকের একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ‘ধূসর স্বপ্ন’তে ফাঁস করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর গণিত বিষয়ের প্রশ্ন। নাটোরে আরও ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। সেখানে প্রথম ও চতুর্থ শ্রেণীর গণিতের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় ১০২টি স্কুলের পরীক্ষা স্থগিত করেছে কর্তৃপক্ষ। ‘ধূসর স্বপ্ন’ জাতীয় অ্যাকাউন্টগুলো দেশের সব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধূসর ও কালিমালিপ্ত করে দিচ্ছে। অথচ আমরা এই শিক্ষা ও শিক্ষার্থী হন্তারকদের শনাক্ত করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে পারছি না। আমাদের প্রশ্ন, প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে কারা, এর সঙ্গে জড়িত কারা? অনেক কিছুই স্পষ্ট এবং চিহ্নিত। কিন্তু তারপরও জাতিবিধ্বংসী অনৈতিক এই প্রবণতা রোধ করতে পারছি না কেন? আমাদের দুর্বলতাটা কোথায়, কোথায় চলেছে প্রিয় স্বদেশ? উল্টো আমরা কেন লিপ্ত রয়েছি একে অপরের কাঁধে দোষ চাপানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায়? দায় কি এড়াতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়?
শুধু প্রশ্নফাঁসই নয়, আরও বিচিত্র ও বিভিন্নভাবে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে। রংপুরের পীরগাছায় পিইসির খাতা মূল্যায়নে করা হয়েছে অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্য! উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ ৬ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারা ৮ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১২শ’ পরীক্ষার্থীর খাতার ভুল সংশোধন করে প্রাপ্ত নম্বরের চেয়ে বেশি নম্বর দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ওই পরিমাণ অর্থ। আর এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছে রংপুরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেন।

জাতিয়াতি চলছে ভর্তি পরীক্ষার বেলায়ও। তারও পদ্ধতি অনেক। অর্থের বিনিময়ে অন্যের হয়ে প্রক্সি ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ধরা পড়ছে অনেকে। ভর্তি পরীক্ষায় ইলেকট্রুনিক্স ডিভাইসের অপব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়ছে পরীক্ষার্থী- এসব যেমন বিস্ময়কর, তার চেয়ে কিন্তু কম বিস্ময়কর নয় যে, পরীক্ষার্থী পরীক্ষাই দেয়নি, এমনকি পরীক্ষা হলের ত্রিসীমানায় উপস্থিতও হয়নি, অথচ ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে সে-ই কিনা ১ থেকে ২০ জনের তালিকার কৃতী পরীক্ষার্থী হয়ে বসে আছে।
এ দেশে এ রকম পরিস্থিতি বর্ণনার জন্য প্রবাদ বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, ‘শর্ষের ভেতরেই ভূতে’র অবস্থান। এই সাদামাটা বাক্যটি দিয়ে কি বর্তমান বাস্তবতাকে বর্ণনা করা যাবে? শর্ষের ভেতরে ভূত, নাকি ‘পুরো শর্ষই ভূতে পরিণত হয়েছে?’ বরং বলা যায় শিক্ষাকে আমরা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার বানিয়ে যূপকাষ্ঠে তুলে দিয়েছি।
আগে নকল যেত হলের বাইরে থেকে ভেতরে। এখন ভেতর থেকেই নানাস্তরে বেরিয়ে আসছে বিবিধ গরল! অভিভাবকরা জোট বেঁধে টাকা নিয়ে সন্তানদের জন্য কিনছেন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। একবারও তারা ভাবছেন না, নিজেদের অর্থে অতি উৎসাহে তারা কোন নরকে ঠেলে দিচ্ছেন তাদের সন্তানদের। এই অন্ধকূপ দিয়ে তারা কোন অতল গহ্বরে পৌঁছবেন? স্বার্থান্ধ আত্মঘাতী এই বাঙালির কথা ভেবেই কি কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন-
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’
[অদ্ভুত আঁধার এক। জীবনানন্দ দাশ]

আমরা নতুন করে পরামর্শক দলে যোগ দিতে চাই না। আমরা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আবেদন জানাই- কবি কথিত হৃদয়ে ‘প্রেম-প্রীতি-করুণার আলোড়ন’ নিয়ে নিজেদের সন্তানের কথা ভাবুন। আপনারা আপনাদের সন্তানদের সফলতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে একটি অন্ধকূপের মধ্য দিয়ে ধাবিত হচ্ছেন, তার পরিণতি কিন্তু আপনাদের আদরের ধন, স্নেহের সন্তানটিকে নিজ হাতে কোরবানি করা। সবার প্রতি সকাতর আহ্বান, এভাবে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎকে কোরবানি দেবেন না। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে ছুটে, অর্থ ব্যয় করে অথবা কৌশলী পন্থা অবলম্বন করে তথাকথিত সাফল্যের আশায় না ছুটে বরং নিজ সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষার পেছনে ছোটান, নিজেরাও সেই পথে ছুটুন। তাহলেই বাঁচবে জাতি, জাতির ভবিষ্যৎ।

 

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/21/181042