১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ২:০১

তৃতীয় নয়ন

দু’টি নির্বাচন ও একটি সত্য

মীযানুল করীম

শুরুতেই সবাইকে স্বাগত জানাই। বছরটি নতুন, তবে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি পুরনো। ‘যায় দিন ভালো,/আসে দিন কালো’ বলা হলেও সদ্য বিগত বর্ষ বিশ্বের জন্য ভালো ছিল না; আর নতুন বছর যে একাধারে মন্দ হবেÑ তা বলাও সম্ভব নয়। আল্লাহ আলিমুল গায়েব (অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী) বিধায় তিনিই জানেন, ২০১৭ কেমন যাবে। তবে এটা হলো তকদির বা অদৃষ্টের কথা। মহান স্রষ্টা কিন্তু তাঁর সৃষ্টির সেরা প্রাণী হিসেবে মানুষকে তদবির বা চেষ্টা-পরিশ্রম করতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি বলছেন, যে জাতি নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্রতী হয় না, আল্লাহ তার ভাগ্য বদলে দেন না।’ বলাই বাহুল্য, ভাগ্য বদলানোর সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও যোগ্যতা সৃষ্টি হতে পারে উপযুক্ত নেতৃত্ব থাকলেই। বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে কতটা সক্ষম ও সফল তা আগামী দিনে সবার কাছে আরো স্পষ্ট হবে।
এবার প্রথমে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের পর দেশের জেলা পরিষদ নির্বাচন হলো। একটা প্রত্যক্ষ, আরেকটা পরোক্ষ। একটার দিকে পুরো দেশের নজর; আরেকটা ‘সেম সাইড’ খেলার মতো এবং আকর্ষণহীন। নাসিক নির্বাচন গত কয়েক বছরের প্রেক্ষাপটে অপেক্ষাকৃতভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ মনে হয়েছে। এতে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন, যে কারণেই হোক, সরকারের সুমতি কিছুটা ফিরে আসছে এবং এর ধারাবাহিকতায় হয়তো আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই জাতি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পাবে। তবে এক সপ্তাহ পরই জেলা পরিষদের যে নির্বাচন হলো, তার পদ্ধতি আর পরিবেশ দেখে আবার হতাশ হতে হয়। একটা জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া জরুরি। তা হলো, সিটি করপোরেশন কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার বদল হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে ক্ষমতাসীনদের তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে সরকার বদল হতে পারে। তাই সে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার গ্যারান্টি পাওয়া যাবে কি?
নাসিক নির্বাচনের নানান দিক
নাসিক নির্বাচনে কে জিতলেন, কে হারলেন? অনেকেই বলেছেন, ব্যক্তিবিশেষ কিংবা কোনো একটি দলের হারজিত নয় এটা। আসলে ভোটাররা জিতেছেন। কারণ নির্বাচনটা দৃশ্যত মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে যাকে এই আমলে অন্তত ‘মন্দের ভালো’ বলে মনকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়া যায়।
কথা হলো, নাসিক নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের জন্য ‘আহামরি’ গোছের নয় কিংবা বিএনপির জন্য আহাজারির কারণ নয়। এই ফলাফলকে সত্যিকার ফলের সাথে তুলনা করে বলা যায়, বিএনপির ফলটা মাকাল নয়। আর আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ফলও কাঁঠাল নয়।
নাসিক নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের জন্য সান্ত্বনা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহলের জন্য অস্বস্তির কারণ কয়েকটি বিষয়: ক) আইভী গত নির্বাচনে যত ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন, এবার সে ব্যবধান কমেছে। এবার তিনি দলীয় প্রার্থী ছিলেন, গতবার নয়। এটা মনে রাখতে হবে। খ) বিএনপি প্রার্থী এবারই প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। অপর দিকে আইভী গতবার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে এযাবৎ ক্ষমতায় ছিলেন। তদুপরি বিএনপি প্রার্থীর মূল পরিচয় আইনজীবী হিসেবে, রাজনীতিকরূপে নয়। এসব বিবেচনায় তিনি নির্বাচনে অবশ্যই জয়ী হবেনÑ এমন মনে করা যায়নি। গ) বিএনপি এবং তার প্রার্থী যে নির্বাচনী দৌড়ে মাঝপথে মাঠ ত্যাগ না করে শেষাবধি ছিলেন, সেটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ঘ) আওয়ামী লীগের বিশাল সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক, সরকারের ও সিটি করপোরেশনে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার প্রভাব ও সুবিধা ইত্যাদির বিপরীতে চরম দমন-পীড়নে বিএনপি বিপর্যস্ত। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি নির্বাচনের ময়দানে যতটা তৎপর ছিল, তা শতভাগ পর্যাপ্ত না হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাও কম নয়। ঙ) নাসিক নির্বাচন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সক্রিয়, চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করেছে। এটা মাঠের রাজনীতির ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হবে। কর্মীদের উদ্যম ও নেতাদের সক্রিয়তা ধরে রাখতে হবে যথাসাধ্য।
নাসিক নির্বাচনের দিন একটা ব্যাপার অনেকের চোখ এড়ায়নি। তা হলোÑ দুপুরে টিভিতে জানা গেল যে, আইভী বলেছেন, ‘ভোটারদের বাধা দেয়া হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে আসতে।’ অর্থাৎ ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে না পারে। কিন্তু রাতে ফলাফল ঘোষণার পর বিজয়ী আইভী সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’ তা হলে, দিনে কার ভোটারদের কারা বাধা দিচ্ছিল? এই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এ দিকে বিরোধী দলের প্রার্থী ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র আশঙ্কা করেছেন। আর বিএনপির মুখপাত্র হেঁয়ালি করে বললেন, ‘ইলেকশন ইজ ফেয়ার, বাট দি রেজাল্ট ইজ আনফেয়ার।’ এসব সত্ত্বেও সবাই অন্তত এতটুকু স্বস্তি পেয়েছেন যে, আশঙ্কামাফিক বড় অঘটন ব্যতিরেকেই নির্বাচনটা হতে পেরেছে।
ক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিকভাবেই এখন বগল বাজিয়ে, গলা চড়িয়ে দাবি করছে, নারায়ণগঞ্জের বিজয় প্রমাণ করেছেÑ আওয়ামী লীগ কত বেশি জনপ্রিয় এবং বিরোধী দল বিএনপির প্রতি জনসমর্থন অনেক কম। হয়তো এ ধরনের প্রচারণার মধ্য দিয়ে কেউ কেউ আভাস-ইঙ্গিতে বলতে চান, ইলেকশন ফেয়ার হোক আর আনফেয়ার, এটা কেয়ার করার দরকার নেই। কারণ তাদের বিশ্বাসÑ নির্বাচন যেমনই হোক, জিতবেন কেবল আওয়ামী প্রার্থী। দলটির লোকজন যদি কারচুপিও করে, তা হলে সেটা হবে পপুলার রিগিং। অর্থাৎ ব্যাপারটা আনপপুলার তো নয়!
তবে এ ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে বড় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটির কলামের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এই পত্রিকা শুধু সরকার নয়, বিএনপি তথা বর্তমান বিরোধী দলেরও তীব্র সমালোচক, বরং আদর্শিকভাবে ক্ষমতাসীনদের সাথেই তাদের সাযুজ্য ব্যাপক। এই পত্রিকার মন্তব্যটি হলো: The win in Narayanganj is a long boost for the ruling Awami League as it won for the first time a competitive mayoral election by defeating its rival BNP. Its leaders are portraying the win as an expression of people’s confidence in the government. But according to political analysts, Selina Hayat Ivy's personal popularity for her clean image also contributed largely to her win. The AL leaders should pay heed to this points.'
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছু দিন পর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার (এখন সিটি করপোরেশন) নির্বাচনের ফলাফল সারা দেশের নজর কেড়েছিল। তখন এর চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছিলেন আলী আহমদ চুনকা। এই মানুষটি কোনো বড় নেতা ছিলেন না যদিও স্থানীয়ভাবে ছিলেন সুপরিচিত। দেশের মানুষ দেখল, চুনকা নামের একজন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছেন! চুনকাও ছিলেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোক। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলÑ সরকারি দলের অফিসিয়াল প্রার্থীর পরাজয়। আলী আহমদ চুনকা হারিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পছন্দের প্রার্থী খাজা মহিউদ্দিনকে। চুনকা মিঞা নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা। আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ে তার সাথে দ্বন্দ্ব ছিল চাষাঢ়া এলাকার জোহা সাহেবের। মানে, আজকের শামীম ওসমানের বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহার। ১৯৭৩ সালের সে নির্বাচনে বিজয়ী চুনকা দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী মুজিব তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘জানতাম, তুই জিতবি।’ তা জানা সত্ত্বেও কেন স্নেহধন্য চুনকা দলের অফিসিয়াল প্রার্থী হতে পারেননি, সেটা রহস্যই রয়ে গেছে।
নাসিকের নির্বাচনে এবার পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন সেই আলী আহমদ চুনকার কন্যা ডা: সেলিনা হায়াত আইভী। জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী, তথা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আইভীকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আনন্দে। এবার আইভী না হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। গতবার দলের শীর্ষপর্যায় থেকে পছন্দের প্রার্থী ছিলেন সেই জোহা সাহেবের ছেলে শামীম ওসমান। অপর দিকে আইভী সুশীলসমাজ ও বামপন্থীরাসহ নাগরিকদের একটি ফোরামের প্রার্থী হিসেবে অবতীর্ণ হন। ভোটারের বিপুল সমর্থনে লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। আইভী এবং শামীমÑ দু’জনই আওয়ামী লীগের লোক। এই দুই দফা নাসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশবাসী আওয়ামী রাজনীতির বিচিত্র চেহারা ও চরিত্র অবলোকনের সুযোগ পেয়েছে।
জেলা পরিষদ ও ‘বেচাকেনা ডেমোক্র্যাসি’
নাসিক নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীর বিজয়ের পর বহুলালোচিত জেলা পরিষদ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হলে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলনেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।’ সবাই দেখেছেন, জেলা পরিষদের পরোক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড মনোনীত প্রার্থীদের অনেকেই হেরে গেছেন এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহীরা, যা অতীতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘বিদ্রোহীদের জয়ের অর্থÑ দলের নেতাদের প্রতি ভোটারদের অনাস্থা।’ নাসিক নির্বাচনে দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রমাণ মিলেনি, বরং ব্যক্তি ইমেজ বড় ভূমিকা রেখেছে। আর বিতর্কিত জেলা পরিষদ নির্বাচনের পরোক্ষ ব্যবস্থা কার্যত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নয় এবং এটাকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বলা চলে না, বরং এখনকার জেলা পরিষদ নির্বাচন পদ্ধতিকে তুলনা করা হচ্ছে পাকিস্তানি আমলের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্র্যাসি’ বা বিডির সাথে। তবুও আজকের ক্ষমতাসীন মহল এমন নির্বাচনী সাফল্য দেখে তৃপ্তির ডাবল ঢেঁকুর তুলছে।
প্রসঙ্গক্রমে, কথিত বেসিক ডেমোক্র্যাসির কথা বলতে হয়। তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছিল প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানের নেতৃত্বে। ক্ষমতা করায়ত্ত করে তিনি নিজেকে জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শাল বানিয়ে দেন এবং কিছু দিন পর ‘বেসিক ডেমোক্র্যাসি’র মতো অদ্ভুত কিসিমের ‘গণতন্ত্র’ জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত রাজনীতিক এবং ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসেবে অভিহিত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন Basic Democracy means the democracy of the base. (‘মৌলিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে এমন এক গণতন্ত্র যা মর্যাদাহীন ও লজ্জাকর)। আইয়ুবী গণতন্ত্র দুর্নীতির প্রসার ঘটিয়েছিল প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচনের ভোটারদের ভোট বেচাকেনার মাধ্যমে। এ জন্য ব্যঙ্গ করে বেসিক ডেমোক্র্যাসিকে ‘বেচাকেনা ডেমোক্র্যাসি’ বলা হতো। সরকার এর বাংলা করেছিল ‘মৌলিক’ গণতন্ত্র। কিন্তু ব্যঙ্গ করে অনেকে বলতেন ‘মুলা গণতন্ত্র’। সেই কালো দশকের খলনায়ক আইয়ুব খানের কথিত গণতন্ত্রে যে পরোক্ষ নির্বাচনপদ্ধতি ছিল, এখন জেলা পরিষদ নির্বাচনে সেটাই দেখা যাচ্ছে। এতে ভোট বেচাকেনার সুবিধা হয়। প্রশ্ন হলো, স্বৈরশাসকের সেই দৃষ্টান্ত কেন ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার সরকার অনুসরণ করবে?
শেখার বিষয় ও তৃপ্তির ঢেঁকুর
নাসিক ও জেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে শেখার আছে যদি সংশ্লিষ্টরা কিছু শিখতে চান। উভয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের মারাত্মক অন্তর্কলহ ও বিভেদ প্রকট হয়ে উঠেছে। নাসিক নির্বাচনের বেলায় আওয়ামী লীগ আত্মসন্তুষ্টি বোধ করে বাস্তবতা থেকে দূরে থাকলে তার কোনো লাভ হবে না। দলের জনপ্রিয়তা বেড়েছেÑ এমন ধারণার তেমন ভিত্তি দেখা যায়নি। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে ব্যক্তির ইমেজ ও পরিচিতি বিরাট ভূমিকা রেখেছে। আইভী নিজেকে ‘গোঁড়া’ আওয়ামী লীগার হিসেবে দেখাতে চাননি, বরং এ দিক দিয়ে তিনি শামীম ওসমান থেকে নিজের পার্থক্য বজায় রাখতে সচেতন বলেই প্রতীয়মান হয়। তার পক্ষে এবারও সুশীল ও বামদের বড় অংশ ছিল তৎপর।
অপর দিকে জেলা পরিষদ নির্বাচন যেভাবে হলো এবং জেলা পরিষদকে সরকার যে দৃষ্টিতে দেখছে, তা গণতন্ত্রের বিকাশ কিংবা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করাÑ কোনোটারই অনুকূল নয়। পরোক্ষ নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটাধিকারের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তদুপরি ক্ষমতাসীন মহলের বাইরে কারো অংশগ্রহণ না থাকা নির্বাচনটাকে একপেশে ও আকর্ষণহীন বানিয়ে ফেলেছে। জনগণ এমন নির্বাচনের সাথে একাত্মতা বা ঘনিষ্ঠতাবোধ করে না। এর আগে গত কয়েক বছর যারা জেলা পরিষদের প্রধান ছিলেন, তাদের এই পদ বা সুযোগ দেয়া হয়েছিল দলীয় অনুগ্রহ বণ্টনের অংশ হিসেবে। এ দিকে জেলা পরিষদের ক্ষমতা ও কর্মপরিধি কার্যত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় এই ফোরাম তার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য হারিয়েছে। এসব বিষয় সরকার যদি গভীরভাবে উপলব্ধি না করে, তাহলে নির্বাচনের নামে নাটক হবে আর জেলা পরিষদ হয়ে যাবে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ।’
বছরের শেষ দিনে কোনো কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম : ‘শেষ ভালোর তৃপ্তিতে বিদায়ী ইসি।’ নাসিক নির্বাচন তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু হওয়ায় তারা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, অনেক সময় পেটপুরে উপাদেয় খাবার খেয়ে ঢেঁকুর তুললেও শেষে দারুণ বদহজমও হয়ে যেতে দেখা যায়। ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার’ কথাটা যেমন অনেকের বেলায় সত্য, তেমনি পরীক্ষায় প্রধান প্রধান বিষয়ে ডাহা ফেল মেরে ঘটনাক্রমে শেষ বিষয়ের পরীক্ষায় পাস করা যায়। তবুও টোটাল মার্ক অনেক কম থাকায় আসলে পরীক্ষায় ফেল মারাই হয় অনিবার্য।
রাজধানীর পার্শ্ববর্তী ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ না’গঞ্জ আর দেশের জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন তো হলো।; কিন্তু এটাই কি শেষ কথা? না, আসলে নির্বাচন মানে গণতন্ত্রের শুরু। যে সত্যটি নির্বাচনের মূল কথাÑ তা হচ্ছে, প্রার্থী ও ভোটার, উভয়ের দায়িত্ববোধ। উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এবং সে প্রার্থীর জনপ্রত্যাশা পূরণের মধ্য দিয়েই এই দায়িত্বশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এ জন্য প্রথমেই দরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা। সর্বোপরি, থাকা চাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিক অঙ্গীকার। যত দিন সে সদিচ্ছা না থাকবে, তত দিন নির্বাচনটা হবে প্রহসন এবং তার পরিণাম হবে ট্র্যাজেডি।
গণতন্ত্রের প্রাসাদ : নির্বাচনই ভিত্তি
এখন কেউ কেউ জাতিকে জ্ঞান বিতরণ করছেন এই বলে, ‘নির্বাচনই গণতন্ত্রের সব কিছু নয়। তাই কেবল নির্বাচন নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন?’
যারা এ কথা বলছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, কথাটার একাধিক অর্থ হতে পারে। কে কোন্ উদ্দেশ্যে এটা বলছেন, তার ওপর নির্ভর করে কথাটার তাৎপর্য। তবে প্রথমেই বলে নিতে হয়, নিশ্চয়ই গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। আবার যে নির্বাচন থেকে গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেয়া হয়, তা দিয়ে নেত্রীতন্ত্র, দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম হলেও গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। নির্বাচন হলো, গণতন্ত্রের প্রাণ; গণতন্ত্রের ভিত্তি। সে নির্বাচন হতে হয় অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণÑ এককথায় সুষ্ঠু নির্বাচন।
যারা বলছেন, ‘নির্বাচনই গণতন্ত্রের সব কিছু নয়,’ তারা এ কথা বলে কী বোঝাতে চান, সেটাই বিচার্য। কারণ কথাটার এক অর্থ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি আরো অনেক কিছু অপরিহার্য। আরেক অর্থ হতে পারে, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ওপর বেশি জোর দেয়া জরুরি নয়। কারণ, নির্বাচন মোটামুটি হলেও যথেষ্ট। এর পর তো অনেক কাজ বাকি।’
যারা প্রকৃতপক্ষেই গণতন্ত্র চান এবং এর তাৎপর্য উপলব্ধি করেন, তাদের কাছে প্রথম কথাটাই গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয়টি মেনে নিলে গণতন্ত্রের নামে অন্য কিছু কায়েম হবে।
শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও অনস্বীকার্যÑ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গণতন্ত্র নামের প্রাসাদের ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর এই ভবনের আকার যত বড়, আর আয়োজন যত আড়ম্বরপূর্ণ হোক না কেন, এটি ধসে পড়ার আশঙ্কা সময়ের সাথে বেড়ে যায়।
নির্বাচন মানে election এবং এর বিপরীতে selection কিন্তু সব সম্ভবের বাংলাদেশে আজকাল অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই দুয়ের উদ্ভট মিশ্রণ। এটাকে selective election কিংবা elective selection, যে নামেই ডাকুন, এটা নির্বাচনের আদর্শ কিংবা গণতন্ত্রের মডেল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
পুনশ্চ : এবার সারা দেশে জেলা পরিষদ নির্বাচনের দিন সকাল ৯টা ১২ মিনিট। বিভিন্ন স্থানে ভোট গ্রহণ চলছে। একটি টিভি চ্যানেলে দেখাচ্ছিল একটি মডেল উপজেলার ভোটকেন্দ্রের দৃশ্য। জেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছেন একজন জনপ্রতিনিধি। যুবক বয়সী স্বাস্থ্যবান ভোটারটিকে পোলিং অফিসার হাতের আঙুলে কালি লাগিয়ে ব্যালট পেপার দিলেন। পাশেই পর্দাঘেরা জায়গা যেখানে ব্যালটে সিল মারতে হবে। এটা সব নির্বাচনেই দেখা যায় এবং একজন নিরক্ষর সাধারণ ভোটারও তা জানেন। কিন্তু ওই মডেল উপজেলার মডেল ভোটারটি ব্যালট পেপার পেয়েই সবার সামনে সাথে সাথে সিল মারতে উদ্যত হলেন। এমন অভাবনীয় দৃশ্য দেখে যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হতবাক হয়ে যাবেন। যা হোক, পোলিং অফিসার ওই জবরদস্ত ভোটারকে ধরে ফেলে বাধা দেয়ায় তার আর প্রকাশ্যে সিল মারার সাধ পূরণ হয়নি। তাকে পর্দাঘেরা জায়গায় সিল মারতে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটাররা সবাই স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে একেকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাদের কেউ যদি ভোট দেয়ার নিয়মটাই না জানেন, তা হলে তাদের দিয়ে গণতন্ত্রের কেমন খেদমত হবে, তা আর বলে দিতে হয় না।
পাদটীকা : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এসএসসির আগেই স্কুলপর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষা নেয়ায় শিক্ষার্থীদের মন থেকে পরীক্ষাভীতি কেটে গেছে।’ জাতি একান্তই আশা করে, বর্তমান সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচনভীতিও অচিরেই কেটে যাবে।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183699