১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ২:০০

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বছর 2016

চলতি বছর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। দলের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ১০ মে দিবাগত রাতে এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য ও শিল্প উদ্যোক্তা মীর কাসেম আলীর ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে পরে গভীর উদ্বেগ জানায় জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মহাসচিবের স্পোক্সম্যান স্টিফেন ডুজার্সি গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, মহাসচিব বরাবরই মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ঠিক রেখেছেন। মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজপ তায়েপ এরদোগান। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে তার ছেলে ব্যারিষ্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে আইন শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। মৃত্যুর আগে তিনি তার ছেলের সাথে শেষ সাক্ষাতও করতে পারেন নি।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
জামায়াতে ইসলামীর আমীর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড ১০ মে দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়েছে। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
এর আগে রাত ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাত করেন পরিবারের সদস্যরা। স্বজনদের মধ্যে মাওলানা নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী, ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, ডা. নাঈমুর রহমান, দুই পুত্রবধূ, দুই নাতি, বড় মেয়ে মহসিনা ফাতেমাসহ ২৪ জন সাক্ষাত করেন। তারা রাত সাড়ে ৯টার সময় কারাগার থেকে বের হন।
রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশ ১০ মে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পাঠানো হয়। রাত ১ টা ৩০ মিনিটে শহীদ নিজামীর লাশ নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এ্যাম্বুলেন্স রওনা করে তার গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। সকাল ৬টা ২০মিনিটে লাশবাহী বহর পৌঁছে সাঁথিয়ার মনমথপুরে জন্মভুমিতে। সেখানে পুর্বই থেকেই উপস্থিত ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। শহীদ নিজামীর কফিনবাহী গাড়ীর বহর বাড়ীতে পোঁছলে সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সাধারণ মানুষ তাদের নেতাকে এক নজর দেখার জন্য আকুতি করতে থাকে এবং ঠুকরে কেঁদে ওঠে। তাদের সমস্বরের কান্না মন্মথপুরের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। তাদের অবস্থা সামলাতে অস্ত্রধারী আইন শৃংখলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হয়।
তারপর কফিনবাহী এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ী সংলগ্ন মন্মথপুর কবরস্থানে। সেখানে পুর্ব থেকেই অপেক্ষমান হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে জানাযায় দাঁড়িয়ে যায়। সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত জানাযায় অন্তত ১০ হাজার মানুষ শরীক হয়। জানাযা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকেরা লাশ নিয়ে যায় কবরস্থানে। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো সাধারণ মানুষ কবরস্থানে ঢুকে পড়তে চাইলে আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের বাধা দেয়। তাদের বাধা উপেক্ষা করে হাজার মানুষ কবরস্থানে প্রবেশ করে। শতবাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দাফনের পর একই স্থানে ২৬ বার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
দেশে বিদেশে জানাযা : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর গায়েবানা জানাযা দেশে বিদেশে লাখ লাখ জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে ১১ মে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে একাধিক গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। গায়েবানা জানাযা শেষ হওয়ার পর মুসুল্লীরা শ্লোগান দিতে দিতে মসজিদ থেকে বের হয়।
চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দান ও তার সংলগ্ন সড়ক, সিলেটের সরকারী আলিয়া মাদরাসা ময়দান, রাজশাহীর হেতেম খা গোরস্থানসহ প্রতিটি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা, জনপদে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের বাইরে মদীনার মসজিদে নববী, জেদ্দা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক, মিশিগান, ব্রুকলেন, লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক, তুরস্কের আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল, ওমান, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী, কানাডার মন্টিয়াল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কাশ্মিরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
রিভিউ খারিজ: মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ (পুর্নবিবেচনার) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় ৯ মে প্রকাশের পর তা ১০ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে রায়ের অনুলিপি কারাগারে পৌঁছে ট্রাইব্যুনাল থেকে। এরআগে বিকেলে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদি হাসান রায়ের অনুলিপি ট্রাইব্যুনাল নিয়ে যান। সেখান থেকে রায়ের এ অনুলিপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যায়।
এর আগে বেলা সোয়া ৩টার দিকে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা মাওলানা নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২২ পৃষ্ঠার পুর্ণাঙ্গ রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে অপর তিন বিচারপতি রায়ে সই করেন।
৫ মে মাওলানা নিজামীর রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তখন “ডিসমিসড” এই এক শব্দে রিভিউ আবেদন খারিজের আদেশ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে আপিলে তিনটি অভিযোগে দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল থাকে।
এর আগে ৩ মে সকাল ৯টা ২৫ মিনিট থেকে ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন মাওলানা নিজামীর প্রধান কৌসুলি ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। এরপর ১০ মিনিট এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রসিকিউশন পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। মাঝে আধা ঘণ্টার বিরতি শেষে এটর্নি জেনারেল তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর আদালত রায়ের জন্য ৫ মে দিন ধার্য করেন। ওইদিন আদালত ‘ডিসমিসড’ বলে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। আদালতে শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেনকে সহায়তা করেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন।
আপিল ও মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : গত ২৯ মার্চ মাওলানা নিজামীর আইনজীবীরা খালাস চেয়ে আপিলের রায় পুর্নবিবেচনার আবেদন করেন। ৭০ পৃষ্ঠার মূল রিভিউর আবেদনের সঙ্গে মোট ২২৯ পৃষ্ঠার নথিপত্রে ৪৬টি (গ্রাউন্ড) যুক্তিতে খালাস চান তার আইনজীবীরা। রিভিউ আবেদনের এডভোকেট অন রেকর্ড হলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন তুহিন।
এর একদিন পরেই সরকারপক্ষে শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য আবেদন করে। সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩০ মার্চ আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে ৩ এপ্রিল দিন নির্ধারণ করেন। ওইদিন ডিফেন্সপক্ষে ৬ সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত এ সপ্তাহ নয় বলে আদেশ দেন। মামলার প্রধান আইনজীবী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে সময় চাওয়া হয়।
১৫ মার্চ আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হয়। সে হিসেবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত রিভিউ করার সময় ছিল। তার আগেই মাওলানা নিজামীর পক্ষে তার আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন করেন।
১৬ মার্চ মাওলানা নিজামীর সঙ্গে আইনজীবীরা কাশিমপুর কারাগারে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি রিভিউ করার পরামর্শ দেন। মাওলানা নিজামী তার আইনজীবীদের বলেন, তিনি নির্দোষ। যে অভিযোগে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্কও নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন রিভিউ করার পর ন্যায়বিচার হলে তিনি খালাস পাবেন। আগেরদিন ১৫ মার্চ মাওলানা নিজামীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ রায়ে স্বাক্ষর করলে ওইদিন রায় প্রকাশ হয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনটি অভিযোগে মাওলানা নিজামীর মৃত্যুদণ্ড, তিনটিতে খালাস, দুটিতে যাবজ্জীবন দেয়া হয়। এরআগে গত ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করেন।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মাওলানা নিজামীর মামলায় রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়। অপর চারটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এছাড়া বাকি আটটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মাওলানা নিজামীকে অভিযোগগুলো থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের দেয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ নবেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তিনি। ছয় হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার আপিলে মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে খালাসের আরজি জানান মাওলানা নিজামী। মোট ১৬৮টি যুক্তি দেখিয়ে এ আপিল করা হয়।
২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দ্বিতীয় দফায় গত ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমান রাখেন।
২০১০ সালের ২৯ জুন কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মাওলানা নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এক আবেদনে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
বিশ্বব্যাপি প্রতিক্রিয়া : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে পরে গভীর উদ্বেগ জানায় জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মহাসচিবের স্পোক্সম্যান স্টিফেন ডুজার্সি গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, মহাসচিব বরাবরই মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ঠিক রেখেছেন।
মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজপ তায়েপ এরদোগান। তিনি বলেছিলেন, আজ বাংলাদেশে ৭৫ বয়সী একজন মুজাহিদের বিরুদ্ধে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়েছে। যিনি এ পৃথিবীতে কোন ধরণের অপরাধ করে থাকতে পারেন বলে আমরা বিশ্বাস করি না। তারপরও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করায় তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং এ বিষয়টি জাতিসংঘ এবং ওআইসিতে উত্থাপনের আহ্বান জানানো হয়।
মাওলানা নিজামীর ফাঁসির দন্ডাদেশ স্থগিত করতে আহ্বান জানিয়েছিল মার্কিন কংগ্রেসের আহ্বান। বিচারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অনুপস্থিতি ও স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের টম লেন্টাস হিউম্যান রাইট্স কমিশন এ আহ্বান জানায়।
মাওলানা নিজামীর বিচার প্রক্রিয়া সুস্পষ্টত মান সম্মত হয়নি বলে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের যুদ্ধাপরাধ ও বৈশ্বিক অপরাধের বিচারবিষয়ক বিভাগের সাবেক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ। সাজা স্থগিত করে আন্তর্জাতিক ন্যায্য বিচারের মানদ- অনুযায়ী স্বাধীন তদন্ত করার আহ্বান জানায় ইংল্যান্ডের বার হিউম্যান রাইটস কমিটি।
মাওলানা নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী। আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বার বার বিচারের ত্রুটি নিয়ে কথা বলে আসছে। তারা মনে করে, নৃশংসতাকে ত্রুটিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়া দিয়ে ভোলানো ঠিক হবে না।
নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর, যিনি ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পুরস্কার পাওয়া চার পাকিস্তানীদের একজন। তিনি বলেন, নিজামী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে বিভাজিত করবে।
এ ছাড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), বার হিউম্যান রাইটস কমিটি ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস, মুসলিম ব্রাদারহুড, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক রমাদান, ইসলামিক হিউম্যান রাইটস কমিশন (IHRC), নো পিচ উইদাউট জাস্টিজ (NPWJ), মুসলিম উম্মাহ নর্থ আফ্রিকা, ইসলামিক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা, ইসলামিক স্কলার হারুন ইয়াহিয়া, ইসলামিক স্কলার ওমর সুলাইমান, জাস্টিস ত্বাকী ওসমানী, ফিলিস্তিন উলামা পরিষদ, মালয়েশিয়ার আবিম ও পাস, হিজবুল মুজাহিদিন ব্র্রাজিলের প্রখ্যাত আলেম শোয়খ রুদ্রিগোয়েজ, রাইটার ইউনিয়ন অফ তার্কি, জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তান, জামায়াত-ই-ইসলামী হিন্দ, তুরস্কের সাদাত পার্টি, তুরস্কের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন এনাতোলিয়ান ইয়ুুথ এসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন, আর্ন্তজাতিক ব্যক্তিবর্গ।

মীর কাসেম আলী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সফল শিল্প উদ্যোক্তা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ কার্যকর করা হয়। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ্যাম্বুলেন্সে করে মীর কাসেম আলীর লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
পরিবারের সদস্যদের হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় দেন মীর কাসেম আলী: হাসিমুখে হাত নেড়ে পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানিয়েছেন মীর কাসেম আলী। শেষ সাক্ষাতের পুরো সময়টাতে তিনি ছিলেন প্রাঞ্জল, হাসি খুশি ও স্বাভাবিক। তিনি বলেছেন, তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। মৃত্যুদন্ডের ঘটনায় তিনি বিচলিতও নন। এই মৃত্যু শহীদী মৃত্যু। তিনি বলেন, ‘যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি করেছে তারা কখনোই জয়ী হবে না।’
বিদায়ী সাক্ষাত শেষে তার স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের এ কথা জানান। সাক্ষাতের সময় তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে দেশ ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য দোয়া করেন। পড়নে ছিল পাঞ্জাবী, হাতে লাঠি। যেটা তিনি সব সময় ব্যবহার করতেন। কয়েক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পরিবারের সদস্যরা তার সাথে সাক্ষাত করেন।
মীর কাসেম আলীর পরিবার কাশিমপুর কারাগার শেষবারের মতো সাক্ষাতের জন্য বেলা তিনটা ৪৫ মিনিটে কারাগার কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা ছয়টা ৪০ মিনিটে তারা কারাফটক থেকে বের হন। এ সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।
মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন, মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাছনিম, ছেলের স্ত্রী সাইয়েদা তাহমিদা আক্তার ও তাহমিনা আক্তার, বড় ভাই ডা: মীর নাছিম আলী, ভাইয়ের ছেলে মীর ওসমান বিন নাছিম, ভাইয়ের মেয়ে রায়হানা নাছিমসহ ৪৫ জন সদস্য তার সাথে দেখা করতে কারাগারে যান। পরিবারের ৩৮ জনকে কিছু সময়ের জন্য সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। বিকেল চারটা ৩৫ মিনিটে তাদের সাক্ষাতের জন্য ভেতরে নেয়া হয় বলে কারা সূত্রে জানা গেছে।
কারাগার থেকে বের হয়ে মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন জানান, মীর কাসেম সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। তিনি বলেছেন, তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। মৃত্যুদন্ডের ঘটনায় তিনি বিচলিতও নন। এই মৃত্যু শহীদী মৃত্যু। তিনি বলেন, আফসোস রয়েই গেলো, মৃত্যুর আগে ছেলেকে দেখে যেতে পারলাম না।
আয়েশা খাতুন আরও জানান, উনি (মীর কাসেম আলী) বলেছেন, যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি করেছে তারা কখনোই জয়ী হবে না। একদিন এই দেশে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই এবং ইসলামই জয়ী হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সাক্ষাতের পুরো সময়টাতে তিনি হাসি খুশি ও স্বাভাবিক ছিলেন। তিনি শহীদী মৃত্যুকে মহা বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একে পুরস্কার বলে মনে করেন। তিনি বলেন, তার উপর জুলুম করা হয়েছে। একদিন এর অবসান হবে। তিনি বলেন, আমরাই চুড়ান্ত বিজয়ী হবো। তারা পরাজিত ও লাঞ্চিত হবে। পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তার মতোই তারা যেন আমৃত্যু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যান।
তিনি স্ত্রীকে তার অবর্তমানে পরিবারের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালনের জন্য বলেছেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে কুরআন হাদীসের জ্ঞানার্জনে নসিহত করে গেছেন। তিনি নেতাকর্মীদের দ্বীনি আন্দোলনে অবিচল থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বিদায়ের সময় তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে হাসিখুশিভাবে সবাইকে বিদায় জানান। নাতি নাতনিদের কপালে চুমু খান।
রিভিউ খারিজের পর পরিবারের সাক্ষাৎ : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় পর বিকেলে পরিবারের সদস্যরা মীর কাসেম আলীর সাথে কারাগারে সাক্ষাত করেন। মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন এবং দুই মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাসনিম, পুত্রবধূ শাহেদা তাহমিদা ও তাহমিনা আক্তার এবং ভাতিজা হাছান জামাল খান এবং ছেলে ও মেয়ের ঘরের ৩জন নাতি নাতনি বুধবার বেলা ২টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছান। সাক্ষাত শেষে বিকাল পৌনে চারটায় দিকে কারাগার ত্যাগ করেন তারা।
এ সময় মীর কাসেম আলী তার ছেলেকে কাছে পেতে চান এবং ছেলের সাথে কথা বলেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত জানানো হবে বলে জানান তার স্ত্রী খোন্দকার আয়েশা খাতুন। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাদের ছেলেকে ফেরত চেয়েছেন।
কারাগারে রায়ের কপি : ৩১ আগষ্ট রিভিউ খারিজের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর অনুলিপি সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। ৭ টা ১০ মিনিটের দিকে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা রায়ের অনুলিপি নিয়ে কারাগারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সেখান থেকে রায়ের অনুলিপি কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।
কারা কর্তৃপক্ষ জানান, পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মীর কাসেম আলীকে তার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার রায় পড়ে শোনানো হয়।
মামলার ধারাক্রম : মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ডিসমিসড’ এক শব্দে আদালত রিভিউ আবেদনটি খারিজ করেন। পরে বিকাল ৫ টা ১৫ মিনিটের দিকে রিভিউ খারিজের রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
গত ২৫ জুলাই রিভিউ শুনানির জন্য প্রস্তুতিতে দু’ মাস সময় চাইলে সর্বোচ্চ আদালত এক মাস শুনানি পিছিয়ে দেন। ওইদিন মীর কাসেম আলীর প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ শুনানির দুই মাসের সময় আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে আদালত এক মাসের সময় মঞ্জুর করেন। ওই দিনই ২৪ আগস্ট রিভিউ শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এর ধারাবাহিকতায় ২৩ আগস্ট শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। পরদিন বুধবার শুনানি শুরু হয়ে আবার ২৮ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী শুনানি শেষে ৩১ আগষ্ট রায়ের দিন ধার্য করা হয়।
গত ১৯ জুন আপিল বিভাগের মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। রিভিউ দাখিলের একদিন পরেই সরকার পক্ষ দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। পরে ২১ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ শুনানির জন্য ২৫ জুলাই দিন ধার্য করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আপিল বিভাগের ২৫ জুলাইর কার্যতালিকায় আসে।
এর আগে গত ৬ জুন মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি এবং সাতটি অভিযোগে সাজা বহাল রাখেন সুপ্রিম কোটের্র আপিল বিভাগ। এরমধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
২০১৪ সালের ২ নবেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে দু’ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করেন। ওইদিন মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনায় ট্রাইব্যুনাল।
একই বছরের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের রায় থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেম আলী। তার পক্ষে আইনজীবীরা আপিলটি দাখিল করেন। আপিলটি পাঁচটি ভলিউমে ১৭৫০ পৃষ্ঠার। ১৫০ পৃষ্ঠার আপিলে ১৮১টি যুক্তিতে খালাস চাওয়া হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে ওই দিনই তাকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ছেলে গুম : মীর কাসেম আলীর দ্বিতীয় ছেলে ব্যারিষ্টার মীর আহমদ বিন কাসেম। গত ৯ আগস্ট দিবাগত রাত ১১টায় রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএস এর বাসা হতে সাদা পোশাক পরিহিত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তার কোন খবর জানে তার পরিবারের সদস্যরা।
ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) হাইকোর্টের একজন নিয়মিত প্র্যাকটিশনার। তিনি লিংকস ইন থেকে ২০০৭ সালে ব্যারিস্টার সনদ অর্জন করেছেন। এর আগে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ২০০৫ সালে এলএলবি (অনার্স) পাস করেন। পড়াশুনা শেষে দেশে ফিরে ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) একজন এডভোকেট হিসেবে ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর সনদপ্রাপ্ত হন। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ইংল্যান্ড বারেরও একজন সদস্য।
মসজিদের পাশে শায়িত হলেন মীর কাসেম আলী : অছিয়ত অনুযায়ী মসজিদেরই পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন মীর কাসেম আলী। তার হাতে গড়া মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে মীরবাড়ী জামে মসজিদের উত্তর পশ্চিম কোনে তাকে দাফন করা হয়। রাত সাড়ে ১০টায় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর রাত পৌনে ৩টার দিকে তার লাশ নিয়ে পৌছে আইন শৃংখলা বাহিনী। নামাজে জানাযা শেষে দ্রুত সময়ে মসজিদের পাশের লেবু বাগানে তাকে করা হয়। এ সময় এলাকার মানুষ নামাজে জানাযায় অংশ নিতে চাইলেও কড়া নিরাপত্তা বলয়ের কারণে তারা আসতে পারেনি। তবে ভোর হওয়ার পর সারাদিন দফায় দফায় গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। দিনভর ছিল মানুষের ঢল।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ্যাম্বুলেন্সে করে মীর কাসেম আলীর লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এর আগেই চালাগ্রামের মীরবাড়ি জামে মসজিদের পশ্চিম পাশে তার কবর খননের কাজ সম্পন্ন হয়। এ সময় স্থানীয় প্রশাসন গোটা এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে। এর মধ্যেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের সদস্যরা ৫টি গাড়িতে করে এলাকায় যান। তাদেরকে দেড় মাইল দূরে কলতাবাজার বেইলী ব্রীজের কাছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পথরোধ করে। পরে তারা ৩টি গাড়িতে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে আইন শৃংখলা বাহিনী। কাউকেই মীর কাসেম আলীর বাড়ির দিকে যেতে দেয়নি।
রাত পৌনে তিনটার দিকে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির ১৭টি গাড়ির পাহারায় মীর কাসেম আলীর লাশ মানিকগঞ্জের গ্রামের বাড়ী চালা গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে তার লাশ গ্রহণ করেন সহধর্মিনী খন্দকার আয়েশা খাতুন। পরে পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় কিছু লোকজন নিয়ে ওই গ্রামের মসজিদের পাশে নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। নামাজে জানাযা পড়ান মরহুমের প্রিয়ভাজন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবুল হাসনাত আবদুল হালিম। পরে লাশ কবরে নামান মরহুমের ভাইয়ের ছেলে ইমরান ও ওসমানসহ তিন স্বজন। এসময় পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে দুই মিনিটের জন্য মরহুমের মুখ দেখতে দেওয়া হয়। এলাকার হাজাার হাজার মানুষ জানাজায় অংশ নিতে চাইলেও প্রশাসনের লোকজনের কারণে জানাযায় অংশ নিতে পারেননি। দাফন শেষে প্রশাসনের লোকজনের পাহারায় পরিবারের লোকজনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে রাত ৯টার দিকে এলাকার মানুষ কবরের কাছে আসতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাড়িয়ে দেয়।
মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে মীর কাসেম আলীকে কবরস্থ করা হয়। কবরের চার পাশে রয়েছে লেবুর বাগান।
রাজধানীসহ দেশে বিদেশে গায়েবানা জানাযা : মীর কাসেম আলীর শাহাদাত কবুল ও তার রূহের মাগফিরাত কামনায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশে বিদেশে শত শত গায়েবানা জানাযা ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় মসজিদে পুলিশী কড়া নজরদারীর মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ গায়েবানা জানাযা অংশগ্রহণ করেন। মিরপুরে মীর কাসেম আলীর বাসস্থানের মহল্লার মসজিদে জনতার ঢল নামে। একইভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে গায়েবানা জানাজা ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া গেছে। এ দিকে নিউ ইয়র্ক, তুরস্ক, জাপান, লন্ডন, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে ও পরের প্রতিক্রিয়া : জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরে দু:খ প্রকাশ করে তুরস্ক। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, আমরা (তুরস্ক) দুঃখের সঙ্গে জানতে পেরেছি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আমরা আবারও জোর দিয়ে বলছি যে, এ পদ্ধতিতে অতীতের ক্ষত সারানো যাবে না এবং আমরা আশা করি এই ভুল চর্চা বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের মধ্যে বিভেদ বাড়াবে না।
এ দিকে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে তার প্রক্রিয়া স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৩৫জন সদস্য। তার অভিযোগের ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন ও স্বাধীন তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরে সংযত হওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন, হাইডি হৌতালা, ইজাসকুন বিলবো বারাকান্দিকা, মালিন বরক, ফ্যাবিও মাসিমো কাস্ট্যালদো, ফ্যাবিও দে মাসি, স্টেফান ইক, অ্যানা গোমেজ, হ্যান্স ওলাফ হিঙ্কেল, মারিয়া হিউবুক, ইভা জোলি, ইউসো জুরাইস্তি, জ্যুড কিরটন ডার্লিং, স্টেইলস কৌলুগ্লু, মেরজা কিলোনেন, বারন্ড লমেল, উলরিখ লুনাসিক, স্যাবিন লোসিং, লুইস মিচেলস, ম্যারিনা মিচেলস, দিমিত্রিস পাপাদিমৌলিস, কাতি পিরি, মিশেল রিভাসি, লিলিয়ানা রডরিগুয়েজ, ব্রনিস হোপ, হেলমুট শুলজ, মলি স্কট কাতো, বারবারা স্পিনেল্লি, বারট স্টেস, ইভান স্টেফানিক, মারক তারাবেল্লা, মিগুয়েল আরবান, আরনেস্ট উরতাসুন, ইভো ভাজল, ভ্যারি ক্রিস্টিন ভিজিয়েত এবং জোসেফ উইডেনহোলজার।
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ হাউজ অব লর্ডস এর সদস্য লর্ড কারলাইল কিউসি। বর্তমান ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আর্ন্তজাতিক সহযোগিতার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বিবৃতিতে মীর কাসেম আলীর সন্তান মীর আহমদ বিন কাসেমের অবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। বৃটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান (tobycadman) এর টুইট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
মৃত্যুদন্ড কার্যকরের কার্যক্রম স্থগিতের আহবান জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে তারা বলে, অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে, দ্বিখন্ডিত সমাজে বিভাজন আরো বাড়বে। এ ছাড়া আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানায় হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ।
http://www.dailysangram.com/post/265628-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80-%E0%A6%93-%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%AE-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%A6--%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF