৬ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:১৯

মিয়ানমারের উন্মত্ততা থামানোর আহ্বান

রাখাইনে গণহত্যার শঙ্কা জাতিসংঘের

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চলছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান যায়িদ রা’দ আল হুসেইন। ওই হত্যাযজ্ঞ ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে পৃথক ফৌজদারি তদন্তে সহযোগিতা করতে নতুন একটি কাঠামো সৃষ্টির জন্য তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পাশাপাশি বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মানবাধিকার পরিষদকে মিয়ানমারের উন্মত্ততা থামানোর আহ্বান জানান।
রাখাইনে রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু অন্য সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে যায়িদ রা’দ এ আহ্বান জানান। এদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মানবাধিকার পরিষদের সদস্য, পর্যবেক্ষক সদস্য ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর দীর্ঘ আলোচনা শেষে গত রাতে ৩৩-৩ ভোটে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ভারত, জাপান, ইকুয়েডরসহ ৯টি সদস্য রাষ্ট্র প্রস্তাবের ওপর ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে মিয়ানমার, চীন ও ফিলিপাইন।
২৩ দফা প্রস্তাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের ধারাবাহিক লঙ্ঘন ও তাদের ওপর নিপীড়নের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। মিয়ানমারের প্রতি তার দেশের লোকজনের মানবাধিকার সুরক্ষা এবং তাদের বাড়িঘর, ধর্মীয় স্থাপনা, বাণিজ্যিক ও আবাসিক স্থানগুলো ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের সব ঘটনার স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। যৌন সহিংসতা, হত্যার মতো ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনকে রাখাইনে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবে। অবিলম্বে মানবিক সহায়তা কর্মীদের রাখাইনে প্রবেশের সুযোগ দিতেও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবে মিয়ানমারের এ যাবৎ প্রদত্ত অঙ্গীকারগুলো আমলে নেওয়ার পাশাপাশি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে গণবাস্তুচ্যুতির কারণগুলো সমাধান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইপ্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পেতে বাধা হিসেবে কাজ করছে, এমন আইনগুলো পরিবর্তন করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি রাখার এবং মানবাধিকার পরিষদকে তা জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবের ওপর গত রাতে ভোটের ঠিক আগে মিয়ানমারের প্রতিনিধি বিষয়টিকে তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এ ধরনের অধিবেশন আয়োজনে জাতিসংঘের অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এটি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
চীনের প্রতিনিধিও ভোটের প্রাক্কালে এ প্রস্তাবে ইতিবাচক কোনো ফল আসবে না বলে দাবি করে ‘না’ ভোট দেওয়ার ঘোষণা দেন। ভারতের প্রতিনিধি গত মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তিকে স্বাগত জানান এবং কোনো একক দেশকে ঘিরে প্রস্তাবের ভোটের ক্ষেত্রে ‘অনুপস্থিত’ থাকবেন বলে জানান। ফিলিপাইনের প্রতিনিধি এ প্রস্তাবের পাশাপাশি মিয়ানমারে জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর প্রস্তাবকে সমর্থন না করার কথা জানান। জাপান ও ইকুয়েডরের প্রতিনিধিরাও কোনো একক দেশকে নিয়ে প্রস্তাবের ওপর ভোটে ‘অনুপস্থিত’ থাকার কথা জানান।
উল্লেখ্য, মানবাধিকার পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের সমর্থনে এই বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়িদ রা’দ আল হুসেইন গতকাল দুপুরে বিশেষ অধিবেশনে বলেন, ‘রাখাইনে প্রবেশাধিকার না থাকায় সেখানে কী ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং দৃশ্যত এখনো হচ্ছে তা পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করা এখনো কঠিন হয়ে আছে। তবে রোহিঙ্গাদের কয়েক দশকের রাষ্ট্রহীনতার পাশাপাশি তাদের প্রতি ধারাবাহিক বৈষম্য, আলাদা করে প্রান্তিকীকরণ ও বাদ দেওয়ার নীতি, অনেক পুরনো নিপীড়নের নীতি এবং তার বিচার ও প্রতিকারের কোনো সুযোগ না থাকা, কাছ থেকে গুলি করে ও গ্রেনেড ছুড়ে, ছুরিকাঘাত করে, পিটিয়ে বা শিশুসহ পরিবারের সবাইকে ঘরে আটকে আগুনে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতি করা, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতন, পেটানো, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ করা বা রোহিঙ্গা হিসেবে নিজস্ব পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতি থাকার কারণে তাদের বাড়িঘর, জীবন-জীবিকা ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস করা—এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে যে সেখানে গণহত্যার উপাদান নেই?’
যায়িদ রা’দ আল হুসেইন বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত একটি উপযুক্ত আদালতই এটি (গণহত্যা) আইনগতভাবে নির্ধারণ করতে পারে। তবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেখানে অনতিবিলম্বে প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। ’

মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছে। এখনো রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালাচ্ছে। রোহিঙ্গা পরিচয়ের কারণেই সংখ্যালঘু ওই জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার আগে আগাম বার্তা দেওয়ার ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় যে এগুলো ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। ঐতিহাসিকভাবে অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে এলেও গত পাঁচ বছরে তাদের প্রতি বৈষম্য এর আগের ৫০ বছরের চেয়েও বেড়েছে। তাঁর দপ্তর ও স্পেশাল র্যা পোর্টিয়াররা (বিশেষ দূতরা) অনেক বছর ধরেই রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের বৈষম্যের কথা বলছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ ব্যবস্থাবিষয়ক সমন্বয়ক কমিটির প্রতিনিধি বলেন, মিয়ানমার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যা পোর্টিয়ার ইয়াংহি লি রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন পরিবর্তন না করলে পরিস্থিতি একই থাকবে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে অবশ্যই মিয়ানমারকে উদ্যোগ নিতে হবে। নিপীড়নকারীদের অবশ্যই শাস্তি হতে হবে।
মিয়ানমারবিষয়ক স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সভাপতি মারজুকি দারুসমান বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক যে প্রচারণা আছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গাদের কাছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা ভয়াবহ নিপীড়নের তথ্য পেয়েছেন। ২৫ নভেম্বরও রাখাইনের মংডু ও বুথিডং থেকে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
যৌন সহিংসতা প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত প্রমিলা প্যাটেন বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ইতিহাস বাংলাদেশের এ মানবিকতার কথা মনে রাখবে। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ভয়ংকর যৌন সহিংসতার কথা শুনেছেন।
তবে বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারের প্রতিনিধি বলেন, মিয়ানমার সরকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক আচরণের যে অভিযোগ তুলেছেন, তা মিয়ানমারের প্রতিনিধি নাকচ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, মিয়ানমার সরকার যে উদ্যোগই নেয় না কেন, তা নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতকে মিয়ানমার সরকার তাঁদের দেশে সফরের জন্য স্বাগত জানাবে।
মিয়ানমারের প্রতিনিধি বলেন, শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, প্রমাণ দিতে হবে। মানবাধিকার পরিষদের এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হবে না, যা মিয়ানমার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন আর দ্বিপক্ষীয় কোনো ইস্যু নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তদন্তের ব্যাপারে মিয়ানমার এখনো বিশ্বাসযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মিয়ানমার এখনো রাখাইনে মানবিক সহায়তাকর্মীদের ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের অবাধ প্রবেশের সুযোগ দেয়নি। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়নকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে অভিহিত করেছে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঢলে বাংলাদেশের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে তিনটি দাবি জানান। এগুলো হলো জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনকে মিয়ানমারে অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে, আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন হতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

যুক্তরাজ্যের পক্ষে কমনওয়েলথবিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক আহমেদ বিশেষ অধিবেশনে বলেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ও ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নয়নে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।
চীন গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—উভয়ের বন্ধু হিসেবে তারা নিরপেক্ষ আচরণ করছে। মানবাধিকার পরিষদের যেকোনো উদ্যোগ অবশ্যই গঠনমূলক হওয়া উচিত।
রাশিয়ার প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবাধিকার পরিষদের বিশেষ অধিবেশন আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
নেদারল্যান্ডস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড, জাপান, মিসর, ইরাক, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইসরায়েল, স্পেনসহ অন্য দেশের প্রতিনিধিরাও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বক্তব্যে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানান।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/06/574076