২৭ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:০৮

নিরাপত্তা জামানত ফেরতে আরইবিতে দুর্নীতি

নিরাপত্তা জামানত ফেরত দেয়ার নামে আরইবিতে (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) চলছে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি। মিথ্যা তথ্য ও ভুল হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে। এ অর্থ হাতিয়ে নিতে একটি সিন্ডিকেট নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয়ও নিচ্ছে। পছন্দের ঠিকাদার হলে সময়ের আগে তাদের ফেরত দেয়া হয় নিরাপত্তা জামানত। আর পছন্দের না হলে চলে নানা টালবাহানা, সময়ক্ষেপণ আর হয়রানি। অযৌক্তিক আর দরপত্র সিডিউলবহির্ভূত যুক্তি দেখিয়ে নিরাপত্তা জামানত থেকে কেটে রাখা হচ্ছে টাকা।

আরইবি সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেট এভাবে তালিকাভুক্ত সরবরাহকারী ঠিকাদারের বেশিরভাগের কাছ থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বেশি অর্থ কেটে রাখছে। অভিযোগ আছে, এসব ক্ষেত্রে খোদ বোর্ডের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নাম ভাঙিয়ে পর্যন্ত অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়। যদিও চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসবের কিছুই জানেন না।

সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ঠিকাদার যুগান্তরকে এ রকম অভিযোগ জানিয়ে অবিলম্বে এ অবৈধ কর্তন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তারা এর সঙ্গে জড়িত প্রকল্প সংশ্লিস্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে এ পর্যন্ত কত কোটি টাকা অবৈধভাবে কর্তন করা হয়েছে তা বের করে সুদসহ সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২ কোটির বেশি গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান আরইবিকে ধ্বংস ও বিদ্যুৎ সেক্টরে সরকারের অর্জনকে ম্লান করার জন্য খোদ সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অসাধু চক্র এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এদের সঙ্গে আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা জড়িত। আরইবির এক সদস্য (মেম্বার) যুগান্তরকে বলেন, তার কাছেও এ ধরনের বেশ কিছু অভিযোগ আছে, যেখানে ১০ শতাংশ নিরাপত্তা জামানত ফেরত দিতে গিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি টাকার বেশি অর্থ অবৈধভাবে কর্তন করা হয়েছে। পরে তার হস্তক্ষেপে কেউ কেউ ওই টাকা ফেরতও পেয়েছেন। তার অভিযোগ, আগামী বছরের শুরুর দিকে আরইবি ২ কোটি গ্রাহক পূর্তি উৎসব উদযাপন করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উৎসব উদ্বোধনের কথা রয়েছে। কিন্তু একটি সিন্ডিকেট এর আগেই আরইবির উন্নয়নকে ম্লান করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এ চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কথাও বলেন ওই পর্ষদ সদস্য।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বৈদ্যুতিক পোল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তারা দুটি প্রকল্পে দরপত্র অনুযায়ী পোল সরবরাহ করেছেন। আরইবির তৈরি করা সিডিউল অনুযায়ী সমিতিগুলোতে পোল পৌঁছেও দিয়েছেন। তারপরও অযৌক্তিক ও অবৈধ কারণ দেখিয়ে তাদের দুটি চুক্তির নিরাপত্তা জামানত থেকে ভুল হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ৬৩ লাখ ৮১ হাজার টাকার বেশি অর্থ কেটে রাখা হয়েছে। এ টাকা ফেরত দেয়ার জন্য যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করলেও সিন্ডিকেট নানা টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করছে। টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে।

জানা গেছে প্রকল্প দুটির একটি ১.৫ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্প অন্যটি আরইবি-ডিডিপি-২ প্রকল্প। এর মধ্যে ১.৫ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একটি চুক্তির আওতায় বিভিন্ন সাইজের ৩৬ হাজার ৮৮৫টি পোল সরবরাহ করেছিল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ পোল সরবরাহের জন্য চুক্তির পর তারা দরপত্র সিডিউল অনুযায়ী পোল তৈরি করেন। এরপর কারখানায় ওই পোলের (খুঁটি) প্রথম প্রাক পরিদর্শনের জন্য আরইবিকে চিঠি দেয়। আরইবি থেকে একটি কমিটি পোলগুলো পরির্দশন করে গুণগত মান নিশ্চিত করেন। এরপর অপর দুই কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট পোলগুলো বিভিন্ন সমিতিতে সরবরাহে একটি সিডিউল তৈরি করে দেন। আরইবির দুই কর্মকর্তার স্বাক্ষরে ওই সিডিউল অনুযায়ী বিভিন্ন সমিতিতে পোল পৌঁছে দেয়ার জন্য জানান। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওই সিডিউল অনুযায়ী সমিতিগুলোয় নির্ধারিত সময়ের আগেই পোল পৌঁছে দেয়। তারপরও আরইবির ওই সিন্ডিকেট ভুল ক্যালকুলেশন করে ঠিকাদারের দেয়া ১০ শতাংশ নিরাপত্তা জামানত থেকে অবৈধভাবে ২৬ লাখ ১১ হাজার ৫৬৭ টাকা কেটে নেয়। পোল সরবরাহকারী ওই প্রতিষ্ঠান এ ঘটনায় সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দেখিয়ে অবৈধভাবে কাটা অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য আবেদন করলেও প্রকল্প পরিচালক ও ওই সিন্ডিকেট টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ আছে।

কেটে রাখা টাকা ফেরত দেয়ার জন্য গত ৮ অক্টোবর প্রথম দফায় চিঠি দেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ১৬ নভেম্বর চিঠি দেয়। দ্বিতীয় দফায় চিঠিতে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে পুরো টাকা ফেরত দেয়ার জন্য বলা হলেও এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করছে না আরইবি।

এ প্রসঙ্গে ওই প্রকল্পের পরিচালক একেএম রাশেদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কেন এবং কি কারণে এ টাকা কাটা হয়েছে তাও বলতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আরইবির শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলে জানাবেন।

অপরদিকে আরইই-ডিডিপি-২ প্রকল্পের জন্যও ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২৩ হাজার ৫৬টি পোল প্রস্তুত করে বিভিন্ন সমিতিতে সরবরাহ করে। এ ঘটনায়ও আরইবির দুই কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত সিডিউল অনুযায়ী সমিতিগুলোয় পোল সরবরাহ করা হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আরইবিকে চিঠি দিয়ে জানায়। গত ১০ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালককে (আরইই-ডিডিপি-২) দেয়া চিঠিতে ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জানায়, দরপত্র (২৭.১২.২৬৩৭.১৩১.৬৮.০০১.৯২০) টেন্ডার প্যাকেজ নং ডিডিপি-২-জি-৩৮, সাব-প্যাকেজ লট-১-এর আওতায় তারা ১১টি পবিসে বিভিন্ন সাইজের ২৩ হাজার ৫৬টি পোল উৎপাদন ও সরবরাহ করে। চিঠিতে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী ৫০ শতাংশ, ৭৫ শতাংশ ও ১০০ শতাংশ সময়ের মধ্যে শুধু প্রতিটি সাইজের পোল বিবেচনায় বিভিন্ন পবিসে সরবরাহের শর্ত ছিল। কিন্তু ১০ শতাংশ জামানতের অর্থ পরিশোধকালে আরইবি প্রতিটি পোল প্রতিটি পবিস হিসাবে বিবেচনা করে বিলম্ব জরিমানা হিসাবে তাদের কাছ থেকে ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ২১৬ টাকা অতিরিক্ত কেটে নেয়। অথচ দরপত্র দলিলে সেকশন-৬ সিডিউল অনুযায়ী উল্লিখিত সময়ে শুধু বিভিন্ন পবিসে প্রতিটি সাইজের পোল সরবরাহের কথা উল্লেখ আছে। আরইবির উপপরিচালক রেজাউল করিম ও আ. লতিফ সরদার ও সহকারী প্রকৌশলী নুরুল ইসলামের স্বাক্ষরে ওই সিডিউল তৈরি করা হয়। সেখানে প্রতিটি পবিস হিসাবে পোল সরবরাহ করতে হবে বলে উল্লেখ ছিল না। প্রথম দফায় ১১ হাজার ৭২৪টি পোল পরিদর্শনে এসে আরইবি পোলের গুণগত মান নিশ্চিত করে। এরপর উপপরিচালক রেজাউল করিম ও নুরুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট পোলগুলো কোন কোন পবিসে সরবরাহ করা হবে সে সিডিউল দেন। সিডিউল অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পোল সরবরাহ করে। কিন্তু তারপরও আরইবি কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে তাদের নিরাপত্তা জামানত থেকে ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ২১৬ টাকা কেটে রাখে।

এ প্রসঙ্গে ওই প্রকল্পের পিডি (প্রজেক্ট ডিরেক্টর) আবদুর রহিম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, তারা যে টাকা কর্তন করেছেন সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ অডিট শাখার রিপোর্ট অনুযায়ী কেটেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরকম অসংখ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যুগান্তরকে অভিযোগ করে বলে, আরইবির অডিট শাখা ও প্রকল্প শাখার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট সব ঠিকাদারের কাছে ২ থেকে ৩ শতাংশ ঘুষ দাবি করে। যেসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদেরকে নানা অজুহাতে হয়রানি করা হয়। এরপর ১০ শতাংশ জামানতের টাকা থেকে অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ কেটে রাখা হয়। অভিযোগ আছে আরইবির অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব ঘুষ বাণিজ্য থেকে ভাগ পেয়ে থাকেন। এ কারণে ঠিকাদারদের অভিযোগ তারা আমলে নেয় না।

এ বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। আরইবির প্রেস কনসালট্যান্ট তালুকদার রুমী যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগটি তিনি চেয়ারম্যান মহোদয়কে অবহিত করবেন। যদি ঘটনাটি সত্য হয় তাহলে আরইবির আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/27/175104