২৭ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:০৬

ব্যাংকিং খাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ

আগামী বাজেট হবে ৪৬৮০০০ কোটি টাকা * জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭.৬% * মূল্যস্ফীতি ৫.৫%

‘ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তিত। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য একটি কর্মশালা করেছি। সেখানে সুপারিশের ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। খুব শিগগির এ তিন স্তরের পরিকল্পনা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপস্থাপন করা হবে’, রোববার অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। তিনি ওই বৈঠকে আরও বলেন, পরিস্থিতি বুঝতে আরও একটি ডায়ালগের আয়োজন করা হবে। বৈঠকে উপস্থিত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বৈঠকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্য হচ্ছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য স্থির করা হয়।
এছাড়া প্রতিবছর ঘোষিত বাজেটের চেয়ে প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়ন হার কম হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়নের হার বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয় একই দিন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত সম্পদ কমিটির বৈঠকে।

প্রসঙ্গত, দেশের ভেতর ও বাইরের অর্থনৈতিক গতিধারা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার এবং চলতি অর্থবছরের বাস্তবায়ন হার নিয়ে রোববার অনুষ্ঠিত হয় সম্পদ কমিটির বৈঠক।
বৈঠক দুটিতে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু, অর্থ সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীসহ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়য়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুপুর ১টায় শুরু হয়ে বৈঠক চলে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত।

বৈঠক শেষে সন্ধ্যা ৬টায় অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, রুটিন মোতাবেক দুটি বৈঠক হয়েছে। এতে প্রাথমিকভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটের আকার ঠিক করা হয়েছে। এটি কোনো নির্বাচনী বাজেট কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘না, এটা কোনো নির্বাচনী বাজেট নয়। চলতি বাজেটের ধারাবাহিকতায় নতুন বাজেট করা হবে।’ রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজস্ব আয় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটি ভালো। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন হার ১৩ শতাংশ হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এটি অনেক ভালো।

বৈঠকে উপস্থিত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ভালো। তবে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
রেমিটেন্স সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে বলে বৈঠকে আলোচনা করা হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসা রেমিটেন্স হ্রাসের পেছনে বিকাশকে দায়ী করা হয়। সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বিকাশের দোকান রয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতরে বিকাশ কর্তৃপক্ষ বলছে কোনো ধরনের বিকাশের এজেন্ট বিদেশে অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাহলে সেখান থেকে কারা বিকাশের ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তবে রেমিটেন্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়।
বৈঠকে এডিবি বাস্তবায়ন হার আরও বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়ে ১৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার এডিবি বাস্তবায়ন হয়। শতাংশ হিসাবে এটি ১০ দশমিক ২১। গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিবি বাস্তবায়ন হয় ১০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, যা মূল্য ব্যয়ের ৯ শতাংশ। বৈঠকে আগামীতে এডিবি বাস্তবায়ন হার আরও বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়।

সূত্রমতে, বৈঠকে খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও গেল বন্যার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে তা উল্লেখ করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, খাদ্য সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বন্যার কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও তা এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। ওই হিসাব ধরে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। এটি বাজেটে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। অপরদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে খুব বেশি ঋণ নেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ৩২ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থান আগের থেকে ভালো রয়েছে।
অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি বৈদেশিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কিছুটা ভালোর দিকে যাচ্ছে। এর ইতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়েছে। তিনি বলেন, আমদানি পরিস্থিতি ভালো। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। বিনিয়োগের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ সময় রফতানির প্রবৃদ্ধিও ভালো। আর সব কিছু স্বাভাবিক গতিতে চললে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।
সম্পদ কমিটির বৈঠক : সম্পদ কমিটির বৈঠকে বাজেট বাস্তবায়ন হার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রতিবছর বড় অঙ্কের বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বছর শেষে সংশোধন করে কাটছাঁট করার পরও প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়ন আরও কম হয়। এক্ষেত্রে বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করে কোনো আর্থিক লাভবান হওয়া যায় না। গত পাঁচ বছরের বাজেট বাস্তবায়ন হার পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, প্রতিবছর ঘোষণার তুলনায় বাস্তবায়ন হার কম হচ্ছে। ফলে বাস্তবায়ন হার বিবেচনা করে বাজেট ঘোষণা দেয়া হলে ভালো হবে। সম্পদ কমিটির বৈঠকে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে সংশোধিত বাজেটে ৯০ হাজার কোটি টাকা কামানো হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/27/175100