২৭ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:৩৯

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে

যেসব দেশের অর্থনীতিতে হাইপার ইনফ্লেশন বা অতি দ্রুতগতিতে মূল্যবৃদ্ধি হয়, সেসব দেশে কিছু লোকের জন্য সেই অবস্থাটা অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। হাইপার ইনফ্লেশন হলে তারা আরও তাড়াতাড়ি ধনী হয়। হাইপার ইনফ্লেশন বা অতি মূল্যস্ফীতি কখন দেখা দেয়? যখন কোনো বিশেষ কারণে অর্থনীতি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে যায়। অর্থনীতি ভালো ছিল; কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অথবা অন্য রাষ্ট্র কর্তৃক অবরোধের মধ্যে পড়লে অতি দ্রুত ওই দেশের মুদ্রা মূল্য হারাবে। বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। মানুষ বেশি অর্থ ব্যয় করে পণ্য কিনতে বাধ্য হবে। আর সেসব যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয় তাহলে ওগুলোর ভোগ কমিয়ে দিতে হবে। সোজা কথা হল, যাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত বা যারা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নিজেদের আয়প্রবাহকে বাড়াতে পারবেন না, তাদের অবস্থাভেদে আধা উপবাসের জীবনযাপন করতে হবে।

এ রকম অবস্থায় জনগণ অর্থনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। তারা যেভাবেই হোক বাঁচতে চেষ্টা করে। মজুদদারি হয়ে পড়ে বিক্রেতাদের স্বাভাবিক আচরণ। বাজারে আকাল লাগলে ভোক্তারা এবং অন্য লোকেরা, যারা বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে দাঁড়ায়। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য জনগণ থেকে জোর দাবি ওঠে বটে। তবে সত্য হল, বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিক করার লক্ষ্যে সব পদক্ষেপই যেন ভেঙে পড়ে। বাজার আপন গতিতে চলে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র লোকদের ওপর আঘাত হানার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। দুষ্প্রাপ্যতার মধ্যে কিছু লোকের হাতে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি অর্থ প্রবাহিত হয়। যেহেতু দেশীয় মুদ্রার ওপর তাদের আস্থা থাকে না, সেজন্য তারা স্থানীয় মুদ্রা বাদ দিয়ে অন্য মুদ্রায় বা অন্য ধরনের অ্যাসেটে সম্পদ ধারণ করতে থাকে। বিদেশেও অনেক সম্পদ পাচার হয়ে যায়। এর কারণ হল, অতি উচ্চমূল্য শুধু আস্থাহীনতা বা বিশ্বাসে ঘাটতি সৃষ্টি করে না, পুরো অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সেজন্য কোনো মানুষই চায় না তাদের দেশ যুদ্ধ বা অবরোধের মধ্যে পড়–ক।

আজকের পৃথিবীতে অনেক দেশ বন্ধুর খোঁজ করে শুধু নিজে বাঁচার জন্য। একটি ভূখণ্ড বা দেশ নিজে নিজে কোনো অর্থ বহন করে না। ওই ভূখণ্ড বা দেশ তখনই নাগরিকদের কাছে অর্থবহ হয়, যখন এর নাগরিকরা আস্থা বা বিশ্বাসের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। তারা বেশি খুশি হয় তখন, যখন দেখে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ অথবা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র লোকদের পক্ষে। রাষ্ট্র যদি অতি ধনীদের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে দারিদ্র্য তো দূর হয়ই না, বরং সমাজে ন্যায়বিচারও অনেক দূরে চলে যায়।

অর্থনীতিতে একমূল্য বা স্থায়ী মূল্য বলে কিছু নেই। মূল্যটা নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। কোনো কারণে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, তাহলে সেই পণ্যের মূল্য বাড়বেই। আবার চাহিদা স্বাভাবিক থাকার পর সরবরাহে ঘাটতি হলেও মূল্য বাড়বে। তাছাড়া মূল্যটা নির্ভর করে বাজারের ধরনের ওপরও। বাজার কাঠামো যদি প্রতিযোগিতামূলক হয়, তাহলে মূল্য হবে স্বাভাবিক। কিন্তু বাজার যদি একক ফার্মের বা একক সরবরাহকারীর অধীনে যায়, তাহলে পণ্যের মূল্য সরবরাহকারীই নির্ধারণ করে দেয়। ক্রেতারা ওই মূল্যকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোনো একক ফার্ম বা ব্যক্তি দ্বারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করা প্রতিটি বাজার অর্থনীতিতেই বেআইনি। এজন্য দেশে দেশে কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও কম্পিটিশন কমিশন গঠন করা হয়েছে। যদিও সেই কমিশন আজও কাজ শুরু করেনি।

অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য বাড়লে কিছু লোকের জন্য অপকার না হয়ে উপকারই হয়। তারা হল ওইসব ব্যক্তি যারা উৎপাদন ও সরবরাহের মালিক বা উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে পণ্যমূল্য বাড়ে। তবে কেন উৎপাদন ব্যয় বাড়ে তারও অনেক কারণ আছে। উৎপাদনের উপকরণগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বেই। কিন্তু বাজার যখন একচেটিয়ামূলক হয় তখন উৎপাদন ব্যয় না বাড়লেও বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে। সরকারের কোনো কোনো নীতিও মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দিতে বা মূল্যবৃদ্ধিতে হাওয়া দিতে পারে। যেমন সরকার যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়ায়, তাহলে অন্যান্য পণ্য ও সেবার মূল্যও বাড়বেই। কতটা বাড়বে সেটা অন্য অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে। সরকার যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনে, সেহেতু অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকার আরও কম মূল্যে তেলের বিপণন করতে পারত। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু সরকার অতীতের লোকসানের কথা বলে তেলের মূল্য কমাচ্ছে না, যদিও সেই পুঞ্জীভূত লোকসান অনেক আগেই পূরণ হয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন বছরের আগের মূল্যের অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক দেশ তেলের দাম কমিয়ে তাদের অর্থনীতিতে তেল ব্যবহার থেকে প্রাপ্ত উপকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও ভুলের মধ্যে আছে। তেলের মূল্য কমার কারণে ফার্নেস অয়েল দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস পাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার প্রতি বছরই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার মনোপলিস্ট নয়। এখন ব্যক্তি খাত ৪০ শতাংশের ওপরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু ক্রয় ও বিতরণের ক্ষেত্রে সরকার মনোপলিস্ট। ‘এখনও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে’- এ কথা বলে সরকার বারবারই গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের মূল্য রেগুলেট করার জন্য একটা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আছে বটে; কিন্তু সত্য হল, এই কমিশন জনগণের স্বার্থ না দেখে সরকারের স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য পণ্যের মূল্যও বাড়তে বাধ্য।

বর্তমান অবস্থায় নিন্ম-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণীর লোকরা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সব মূল্য একসঙ্গে সমানুপাতিক হারে বাড়লে কারও কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে, এবং অন্য অর্থনীতিতেও, সেটা হওয়ার নয়। এখন অবস্থা হল, নিন্ম-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের, যারা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ, তাদের আয় প্রকৃত হিসাবে মোটেই বাড়েনি। অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার ৫০ শতাংশেরই মালিক হচ্ছে উপরের ৩-৪ শতাংশ মানুষ। নিন্মের লোকরা দারিদ্র্যকে ভাগাভাগি করে চলার চেষ্টা করছে।

যাদের আয় মোটেই বাড়েনি, তারা কীভাবে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য পণ্যের বাড়তি ব্যয় মেটাবে? এর অর্থ হচ্ছে, তাদের অবস্থার যতটুকু উন্নতি হয়েছিল, সেটা তাদের পক্ষে আর ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাদের সব ক্ষেত্রেই ব্যয় কাটছাঁট করতে হবে। এতে তাদের ওপর দারিদ্র্যের চাপ আরও বেড়ে যাবে। সরকার যেখানে নিজেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেক্ষেত্রে তাদের নির্ধারিত মূল্য যে প্রকৃত ইকোনমিক কস্ট্, তা কে বলল? জনগণ কি সরকারি খাতের অদক্ষতা ও দুর্নীতির জন্যও অর্থ জোগাবে? বিদ্যুতের মূল্য এ মুহূর্তে বৃদ্ধি করা অন্যায়। কিছু লোকের অনেক সুবিধা হবে। কিন্তু অন্য অধিকাংশ মানুষকে ওদের সুবিধার জন্য মূল্য জোগাতে হবে!

আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

 

 

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/11/27/175136