২০ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:২১

সাভার ট্যানারি প্রস্তুত নয়, চামড়া ভারতে পাচারের আশঙ্কা

সাভার ট্যানারিশিল্প চামড়া কিনতে প্রস্তুত না হলেও চামড়ার দাম নির্ধারণে আজ ঠৈবকে বসছে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ট্যানারি মালিকরা। প্লট বরাদ্দ পাওয়া ১৫৪ ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৮/১০টি কারখানা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। আরও ২৫/৩০ ট্যানারি শুধুমাত্র ওয়েট ব্লু’র কাজ করতে পারে। এই ৩৫/৪০ ট্যানারি মালিকরাই এবারের ঈদে চামড়া কিনতে পারে। বাকিরা কাঁচা চামড়া কিনবে না। তাছাড়া সাভার ট্যানারি পল্লিতে উন্নয়ন কাজ চালু থাকার কারণে অর্থ সংকটে রয়েছে মালিকরা। তাই এ বছর কেউ নতুন চামড়া কিনবে না। আর চামড়ার প্রকৃত মূল্য না পেলে পাচার হবে প্রতিবেশি দেশে। এ অবস্থায় চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে এ বছর চামড়ার দাম নির্ধারণে রাজি নয় ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, এবছর কারখানার কাজ চলার কারণে অর্থ সংকটে রয়েছে অনেকেই। এছাড়া কারখানা না থাকার কারণে অনেকে চামড়া রাখার জায়গা নেই। এছাড়া অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে কারখানার কাজ করছেন। এ অবস্থায় চামড়া কিনতে আর নতুন করে কোনো ঋণ দিবে না ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় চামড়ার দাম নির্ধারণ করে কি হবে।
তারা বলেন, সারা দেশে নিয়মিত চামড়াই ক্রয় করা যাচ্ছে না। আর মওসুমী চামড়া ক্রয় করে তারা কি করবেন। তাদের অভিযোগ কারখানা স্থানান্তরের কারণে অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে। নতুন করে রফতানি অর্ডার তারা নিতে পারছেন না। মাত্র ৮/১০ ট্যানারি মালিক রফতানি করছেন। এ দিয়ে সারা দেশের চামড়া সংগ্রহ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তারা আরও বলেন, ওয়েট ব্লু করার পরে বাকি কাজ করতে তাদের অনেক খরচ অতিরিক্ত হয়ে থাকে। বাইরের কারখানায় কাজ করতে হলে প্রতি বর্গফুটে অতিরিক্ত খরচ হয় ১০/১২ টাকা। তাছাড়া রয়েছে কাজের সিরিয়ালও। চামড়া এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় স্থনান্তর করতেও অনেক খরচ হয়ে থাকে। আবাসিক সংকটের কারণেশ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে ব্যয় অনেক বেশি হচ্ছে। সব মিলে নতুন করে কাঁচা চামড়া কেনা অনেক কঠিন হবে।
জানা গেছে, হাজারিবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর প্রায় তিন মাস হয়ে গেলেও গ্যাস সংযোগ মিলছেনা সাভারের চামড়াশিল্পনগরীতে। আসছে কুরবানি ঈদে ৬০ লাখ গরু-মহিষ আর ১ কোটি ছাগল ভেড়া জবাই হতে পারে। কিন্তু এত পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সাভারের চামড়াশিল্পনগরী। এতে করে প্রতিবেশি দেশে কাচা চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র আটটি ট্যানারির। ৮টি ট্যানারি বছরে মাত্র ১০/১২ লাখ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। বাকি দেড় কোটি চামড়ার কি হবে। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়বে ব্যবসায়ীরা আর বঞ্চিত হবে হকদাররা।

প্রতি বছরই শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ট্যানারি মালিকরা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে থাকেন। এ বছরও দাম নির্ধারনের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। দাম নির্ধারণের বৈঠকে চামড়া ব্যবসায়ীদের দাওয়াতও দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৩ সালে শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ বছরে কাজ শেষ হয়নি। পুরো কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। অথচ মিথ্যা রিপোর্টের ওপর আদালতের রায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। এর আগে রায় না মানার কারণে আদালত জরিমানাও করে ট্যানারি মালিকদের। এখন দেখা যাচ্ছে কাজ শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশও। এতে করে কোটি কোটি টাকার রফতানি অর্ডার হারালো ট্যানারি মালিকরা। বেকার হলো কয়েক লাখ শ্রমিক। কিন্তু কার স্বার্থে এ শিল্প ধ্বংস করা হলো তা এখনও অজানা।
সিইটিপি আর ডাম্পিং স্টেশনের কাজও বাকি অনেক। তাই উৎপাদন বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানী। এখন ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিক অসন্তোষের আশংকা করছেন ট্যানারি মালিকরা। এক সময় দিন রাত কাজ চলতো এসব ট্যানারিতে। এখন নিস্তব্ধ আর পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে সব কিছু।
সাভারে স্তানান্তরের জন্য গেলো মে মাসের ৮ তারিখ হাজারিবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর এখন চরম বিপাকে এই শিল্প। হাজারিবাগে সব কাজ বন্ধ, আবার সাভারের আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে শুরু করা যাচ্ছেনা কাজ।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন সাভারে ট্যানারিশিল্প প্রস্তুত হলো না এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। সাভারের ট্যানারিপল্লী ধলেশ্বরী নদীর পানিকে দূষিত করছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির এমন এক আবেদনে আদালত ঈদের ১৫ দিন আগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ না হওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে আদালত এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীন বাংলাদেশ অংশীদারি প্রকল্পের প্রধানসহ তিনজনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর অন্যতম কারন ছিলো এখানকার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ে নষ্ট করেছে নদীর পানি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের হাইকোর্টে দাখিল করা একটি প্রতিবেদন বলছে সাভারে স্থানান্তরের পর ট্যানারির বর্জ্যে গত তিন মাসে সবচেয়ে দূষিত নদীর নাম ধলেশ্বরী।

বিষয়টি গত বুধবার হাইকোর্টের নজরে আনেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা। বেলার নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঈদের বাকি ১৫ দিন, এখনো যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ না হয়, তাহলে কুরবানি ঈদের চামড়ার সব বর্জ্যে বুড়িগঙ্গার মতো অবস্থা হবে ধলেশ্বরীরও।
তিনি আরও বলেন, আমরা বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতেই সাভারে ট্যানারিশিল্প স্থনান্তর করেছি। কিন্তু এখন দেখছি ফল হয়েছে উল্টো। এখনও দূষনে বুড়িগঙ্গার ভাগ্য বরন করছে ধলেশ^র নদী। এখনও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ হয়নি। যে কয়টি ট্যানারি চালু হয়েছে তার বর্জ্য পড়ছে ধলেশ^র নদীতে। আর এ কারনেই আমরা আদালতের দৃষ্টি আর্কষণ করেছি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী বলছেন, তারা বার বার বলার পরও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ করতে পারেনি, চীন-বাংলাদেশ অংশীদারি প্রকল্প। পরে, প্রকল্পের প্রধানসহ তিনজনকে ২২ আগস্ট আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখা দিতে বলেন।
প্রায় ৪০০ কোটির টাকার এ প্রকল্পের শুরু থেকেই চীন বাংলাদেশ অংশীদারি প্রকল্পের বিরুদ্ধে ঢিমেতালে কাজের অভিযোগ ছিলো।
প্রতিবছর ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহায় সবচেয়ে বেশি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হলেও এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার সাভারের প্রস্তুতি শেষ না করে হাজারিবাগের গ্যাস, পানি আর বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পকে।

কুরবানি আসতে বাকি মাত্র ১৫ দিন। দেশে সারাবছর যে পরিমাণ চামড়ার জোগান আসে, এর ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আসে কোরবানির ঈদে। এ সময় দেশে প্রায় ৬০ লাখ গরু-মহিষ জবাই হয়। এ ছাড়া কোটিখানেক ছাগল-ভেড়ার চামড়া পাওয়া যায়। কিন্তু এত পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সাভারের চামড়াশিল্পনগরী। সেখানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কারখানা চালু হলেও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র আটটি ট্যানারির। এতে কোরবানির চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়বে ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব পড়তে পারে কোরবানির পশুর চামড়ার দামেও।

সাভারের ট্যানারি মালিকরা বলছেন, শিল্পনগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টির মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ট্যানারি এখন চালু হয়েছে। তবে অধিকাংশ ট্যানারি শুধু চামড়া কাঁচা প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপের ওয়েট ব্লু উৎপাদন কাজ শুরু করতে পেরেছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী ধাপ- ক্রাশড লেদার ও পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদার তৈরি করার সুবিধা নেই সে সবের বেশিরভাগ ট্যানারিতে। হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি সম্পূর্ণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। এ কারণে কোরবানির পশুর চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ থাকবে না অধিকাংশ ট্যানারি মালিকের।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ক্রাশড ও ফিনিশিংয়ের কাজ করছে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তদের মধ্যে আটটি ট্যানারি। এসব ট্যানারিতে মাত্র ৮/১০ লাখ চামড়া ফিনিশড লেদার তৈরি করতে পারবে। বাকি প্রায় দেড় কোটি চামড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এতে করে চামড়ার ব্যবসায়ী এবং গরিব হকদাররা ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবেন। যারা গ্যাস সংযোগের অভাবে এসব প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি, তারা চরম প্রতিযোগিতায় পড়বে। অনেকে লোকসানের ভয়ে কোরবানির চামড়ায় আগ্রহ দেখাবে না। এমনটা হতেই পারে। এ ছাড়া অনেক ট্যানারি মালিক অবকাঠামোর কাজের জন্য পূঁজি সংকটে ভুগছে। তারাও চামড়া কিনতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, চামড়াশিল্প যখন নানা সংকটে ভুগছে তখন মওসুম আমাদের সামনে হাজির। আমরা এ বছর আসলে কি করবো তা জানি না। এ অবস্থায় চামড়ার দাম নির্ধারণে আমাদের ডেকেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ বছর চামড়া কিনতেই রাজি নয় ব্যবসায়ীরা। তাহলে দাম নির্ধারণ করে কি হবে। তার পরেও বৈঠকে আমাদের বাস্তব অবস্থা আমরা তুলে ধরবো।
সরেজমিন সাভার চামড়াশিল্পনগরী ঘুরে দেখা গেছে, শিল্পনগরীর এখনও অনেক প্লট একেবারেই খালি পড়ে রয়েছে। আর সম্পূর্ণ প্রস্তুত কারখানা আটটি। এর বাইরে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে যারা শুরু করেছে তাদের মধ্যে বেশিভাগেরই আবার অবকাঠামো শতভাগ প্রস্তুত নয়। তার মধ্যেই চলছে চামড়ার কাজ। নগরীর সামনের সারিতে কয়েকটি বড় ট্যানারির কাজ করছে তবে পেছনের দিকে এখনও বেশিভাগের কাজ শুরু হয়নি অথবা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে।

ইউসুফ ট্যানারির মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সবাই এখন স্বাভাবিক পরিমাণের কাজ তুলতেই চাপের মধ্যে পড়ছে। তখন তো অনেক বেশি চামড়া আসবে। এ অল্পসংখ্যক রেডি ট্যানারিতে এতো চামড়া কীভাবে প্রক্রিয়াকরণ হবে? এ কারণে এবার ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়ার প্রতি আগ্রহ হারাবে। এতে চামড়ার দাম এবারও কম যাবে।

সীমান্ত পথে চামড়া ভারতে পাচারের কোনো শঙ্কা আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ আশঙ্কা এ বছর আরও বেড়েছে। এবার বড় সঙ্কট হলো অর্থ। চামড়ার প্রকৃত মূল্য না পেলে তা পাচার হবেই। কোনোভাবেই তা ঠেকানো যাবে না। অর্থ সংকটের কারণে এবার ভারতীয় টাকায় চামড়া কেনা হবে এবং তা পাচার হতে বাধ্য। জানিনা এ বছর কি হবে। আজ দাম নির্ধারণী বৈঠক।
জানা গেছে, গত বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ টাকা, যা এর আগের বছর ছিল যথাক্রমে ৫০ ও ৫৫ টাকা এবং ৪০ ও ৪৫ টাকা। দাম কম নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে গত বছর গরুর চামড়া ঢাকায় প্রতিটি ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/296739