২৬ মার্চ ২০২৫, বুধবার

ওষুধের দাম বেঁধে দেওয়ার পক্ষে ৯৭ শতাংশ মানুষ

জীবন রক্ষাকারী ১১৭টি ওষুধের দামে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাকিগুলো প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ঠিক করে। ফলে এসব ওষুধের দাম দফায় দফায় বাড়লেও কিছুই করার থাকে না। সংকটে পড়তে হয় রোগীদের। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে সব ধরনের ওষুধের দাম সরকার থেকে বেঁধে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনমত জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে সংস্থাটি। এতে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে ১১ ধরনের পদক্ষেপের কথা বলেছেন অংশগ্রহণকারীরা।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অনুরোধে এ জরিপ করে বিবিএস। পুরো স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রতিবেদন ঈদুল ফিতরের পর প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেবে সংস্কার কমিশন।

জানা যায়, সরকারি বিশেষায়িত, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও বেসরকারি চিকিৎসা সেবার মান সম্পর্কে ৬৪ জেলার শহর এবং গ্রামের ৮ হাজার ২৫৬টি পরিবারের ওপর এ জরিপ করা হয়। নমুনায়নের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিটি খানা থেকে ১৮ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী একজন করে নারী-পুরুষের মতামত নেওয়া হয়েছে।

জরিপে বলা হয়, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট নয়। গত বছর ৩৯ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনো সেবাই নেননি। সেবাগ্রহীতার তিনজনের একজন মনে করেন, এসব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান খারাপ।
সরকারি সেবায় দুরবস্থার কারণে বড় অংশ ছুটছে বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসাসেবা অনেক ব্যয়বহুল। ৯৫ ভাগ মানুষ মনে করেন, বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে খরচ অনেক বেশি। ওষুধের ক্ষেত্রে একই চিত্র বলে জানিয়েছেন ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে অবহেলার শিকার হয়েছেন ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। বেসরকারিতে চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ওষুধ, অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসকের পরামর্শ মূল্য নির্ধারণে মত দিয়েছেন বেশির ভাগ মানুষ।

জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট। সেবার মান বাড়াতে সব হাসপাতালকে যুক্ত করে সরকারিভাবে ২৪ ঘণ্টা জরুরি রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালুর পক্ষে ৯৯ শতাংশ। রোগীদের স্মার্ট হেলথ কার্ড ৯৩; স্বাস্থ্য বীমা চান ৬৯ শতাংশ মানুষ। গ্রামাঞ্চলের ৬৮ ও শহরের ৭২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমার পক্ষে। বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবা পেতে প্রথমে প্রাথমিক সেবাদানকারী এমবিবিএস বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে রেফারেল নেওয়া বাধ্যতামূলক করার পক্ষে ৭১ শতাংশ। গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমবিবিএস চিকিৎসক চান ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সঙ্গে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় কমাতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে ৯২ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন।
বিবিএস বলেছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ কমের কারণে ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। ৮৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এ খাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দ চান। ৯১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক অধিকার করার পক্ষে।

বেসরকারিতে অস্ত্রোপচার খরচ বেশি
জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অস্ত্রোপচার খরচ অনেক বেশি। ২ দশমিক ৮ শতাংশ খরচ কম মনে করেন। মন্তব্য করেননি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সেবা নেওয়া ৮৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ওষুধের দাম খুব বেশি। ৩ শতাংশের মত, দাম কম। আর ৯ দশমিক ১ শতাংশ মতামত দেননি। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের মূল বা জেনেরিক নাম লেখার পক্ষে ৪৪; নাম ব্যবহারের পক্ষে ১৭ শতাংশ। তবে ৩২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে একই সঙ্গে জেনেরিক ও কোম্পানির নাম লেখা উচিত।

বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে ও খরচ কমাতে ৯৭ শতাংশ মানুষ মূল্য বেঁধে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে ৯৫ শতাংশ সেবা সহজলভ্য করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ চান। চিকিৎসক এক রোগীকে কমপক্ষে ১৫ মিনিট দেখবেন বলে মনে করেন ২৫ দশমিক ২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ জাকির বলেছেন, সরকারি সব হাসপাতালে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। বেসরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে সেবা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জরিপের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্যের বাজেট বাড়ানো ও দ্রুত স্বাস্থ্য বীমা চালুর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে পারবেন না। সরকারি হাসপাতালে রেফারেল সিস্টেম গড়ে তোলা হবে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে সঠিক ওষুধ লিখছেন কিনা, তা নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন বলেন, রোগীদের বিদেশমুখিতা কমাতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা মিলে বড় বড় হাসপাতালে বিনিয়োগ করা হবে। এতে স্বল্পমূল্যে বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান সমকালকে বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কমিশনের কয়েক সদস্য দেশের বাইরে থাকায় সই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য ৩১ মার্চের পরিবর্তে ঈদুল ফিতরের পর প্রতিবেদন জমা দিতে দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি।’

https://samakal.com/bangladesh/article/287394