২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীন একে অপরের সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে যাচ্ছেন আজ। প্রধান উপদেষ্টা মূলত চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিতেই সেখানে যাচ্ছেন। এর আগে গত ২০ জানুয়ারি ৫ দিনের সরকারি সফরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন চীন গমন করেন। এ সময় তিনি সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সভায় মিলিত হন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চারদিনের চীন সফর নিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মানুষের মাঝে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা। এ ছাড়া বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছরই। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া কী
অলাভজনক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ‘বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া’ এশিয়ার ২৫ রাষ্ট্রসহ ২৮টি রাষ্ট্র নিয়ে ২০০১ সালে গঠিত হয়। বোয়াও ফোরামের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণকে উৎসাহ জোগানো এবং এশীয় দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন লক্ষ্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। প্রতিবছর মার্চের শেষ সপ্তাহে বোয়াও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া অনেক দিনের রেওয়াজ। চীনের দক্ষিণের শহর হাইনানেই এ সম্মেলনের স্থায়ী ভেন্যু। জায়গাটির নাম অনুযায়ী এর নাম হয়েছে বোয়াও, সেখানেই এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। বোয়াও ফোরামের অন্তর্ভুক্ত সব সদস্যরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান অথবা সরকারপ্রধান নিয়ে এ সম্মেলনটি আয়োজন করা হয়। বোয়াও ফোরাম প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ভি রামোস, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হাউকে এবং জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মরিহিরো হোসকার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ বছর সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে এশিয়ার ভবিষ্যৎ গঠন’। অনেক বড় বড় প্রস্তাব এ সম্মেলনে ঘোষিত হয়। ২০২২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ সম্মেলন থেকেই বৈশ্বিক নিরাপত্তার উদ্যোগ (গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ) ঘোষণা করেছিলেন, যেটি চীন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ২৭ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা এ সম্মেলনের উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বোয়াও ফোরামের রয়েছে আলাদা একটি তাৎপর্য।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ
শুধু একটি ভাষণের মধ্যেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বিশ্বখ্যাত পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তৃতা করবেন। সেখানে দ্বীপক্ষীয় বৈঠকেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশ নেবেন। হুয়াওয়ের একটি উচ্চ প্রযুক্তির উদ্যোগ তিনি পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়া রয়েছে আরও অন্যান্য কর্মসূচি। প্রধান উপদেষ্টার এ সফর চীন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং অনেকটা রাষ্ট্রীয় সফরের মতোই। প্রধান উপদেষ্টাকে সেদেশে নিতে চীন থেকে বিশেষ বিমানও পাঠানো হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটি দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য অনেক সম্মানের। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সময় চীন সফর করছেন, তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেকটা সুতার উপর দাঁড়িয়ে। এ বছরই বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। এ উপলক্ষ্যেও নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফর থেকে বাংলাদেশ কী প্রত্যাশা করে এবং চীন এখান থেকে কী অর্জন করতে চায়। মোটা দাগে দেখলে চীন চায় দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বৃদ্ধি এবং এ অঞ্চলের পণ্যের বাজার ধরে রাখতে। গোটা পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। চীনা পণ্যের অনেক বড় বাজার এখানে। যে কোনো মূল্যে চীন চাইবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। এ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলারের উপরে। চীন চাইবে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশে বাণিজ্যের পরিমাণ আরও বাড়াতে। পাশাপাশি, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীনের অত্যন্ত সুসম্পর্ক। তাদের এ সম্পর্ক বহুমাত্রিক। চীন ও পাকিস্তান উভয়েই একে অপরকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর তার বড় প্রমাণ। প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ১২০০ মাইলের এ করিডর পাকিস্তানের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে চীন। বাংলাদেশের সঙ্গেও রয়েছে চীনের দীর্ঘকালের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পেলে ভারতকে কিছুটা হলেও চাপে রাখা যাবে বলে চীন বিশ্বাস করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ সফরে ভূরাজনৈতিকভাবে এ অঞ্চলে চীনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (এক অঞ্চল এক পথ) আওতায় বাংলাদেশে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ৩৫টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। ইতোমধ্যে গুরুত্ব বিবেচনায় বেশ কয়েকটা প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমানও হয়েছে। সেগুলো হলো-পদ্মা সেতুসংলগ্ন ১২টি সড়ক, পদ্মা সেতু রেল লিংক, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার, পটুয়াখালীতে নির্মিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চলমান প্রকল্পগুলোতে গত ৯ বছরে প্রায় ৬ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। চীন চাইবে এ প্রকল্পগুলোর কাজ নিঝর্ঞ্ঝাটভাবে চলমান থাকুক। এগুলো থেকেও চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী বাংলাদেশ যেন এক চীন নীতির ওপর অটুট থাকে এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হয়। ওই সময় ২ দিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন চীনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। সেই যৌথ ইশতাহারে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বীকার করেছে যে, শুধু একটি চীন আছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বৈধ সরকার। তাইওয়ান সম্পর্কে সেখানে উল্লেখ ছিল, তাইওয়ান চীনা ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং এটি ধরে রাখার জন্য অন্য যে কোনো দেশের এক চীন নীতির ওপর জোরালো সমর্থন থাকতে হবে। চীন এ বিষয়টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। চীন প্রত্যাশা করে, বাংলাদেশে যেহেতু ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, তাই বর্তমান সরকার যেন এক চীন নীতির ওপর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। এছাড়া ২০২১ সালে চীন কর্তৃক প্রস্তাবিত জিডিআই’র উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন অংশীদারত্বকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং শক্তিশালী, সবুজ ও স্বাস্থ্যকর বৈশ্বিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা। এর লক্ষ্যমাত্রা হলো জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ এজেন্ডাকে সমর্থন করা। চীন চায় বাংলাদেশ জিডিআইতে অংশগ্রহণ করুক।
অন্যদিকে বাংলাদেশ চাইবে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে। সেখানে চীনা কারখানাগুলো স্থাপন করতে। চীনে রপ্তানি পণ্যের পরিধি বাড়াতে অধিক সচেষ্ট হবে বাংলাদেশ। এছাড়া গত বছর ৫ আগস্টের পর ভারত বাংলাদেশি রোগীদের নতুন করে ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে। সেক্ষেত্রে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর কুনমিং হতে পারে বাংলাদেশি রোগীদের বিকল্প ঠিকানা। বাংলাদেশ থেকে চীনের সবচেয়ে কাছের শহর কুনমিং। যদিও বাংলাদেশ ও চীন উভয়ই এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছে। বাংলাদেশি রোগীদের ১৪ সদস্যের একটি দল গত ১০ মার্চ কুনমিংয়ে গেছে। বাংলাদেশ চায় এখানকার রোগীদের জন্য চীন সহজ ভিসানীতি চালু করুক; বিমানের ভাড়া হ্রাস এবং কুনমিংয়ে হাসপাতালগুলোয় রোগীরা যাতে খুব সহজেই চিকিৎসাসেবা নিতে পারে, চীন সে ব্যবস্থা করুক। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে চীনকে অনুরোধ করেছে, ঢাকায় চীন একটি আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনে বিনিয়োগ করুক। পাশাপাশি তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার ইস্যুতে বাংলাদেশ চীনের সহযোগিতা চেয়েছে। ২০২১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চীনের সহায়তা চেয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। প্রকল্পটি দুবছরের সমীক্ষা শেষে ২০২৩ সালে চীন বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারত এ ব্যাপারে আপত্তি করলে বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি। প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকে কেন্দ্র করে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সামনে এসেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে বাংলাদেশ মনে করে। চীন এ বিষয়টি নিয়ে আগে কাজও করেছে। বাংলাদেশ চায় চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগ গ্রহণ করুক।
যে কোনো দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ৫০ বছর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। বাংলাদেশ ও চীন দীর্ঘ সে সময়টা পার করেছে। গত ৫০ বছর বাংলাদেশ ও চীন একে অপরের ঘনিষ্ঠ ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর হবে দুই দেশের জন্যই একটি মাইলফলক। সামনের দিনগুলোয়ও বাংলাদেশ ও চীন একে অপরের বন্ধুত্বের হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।
ড. মো. সাহাবুল হক : অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট