২৫ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার

গাজায় বসবাস, গাজাবাসীর অধিকার

-জালাল উদ্দিন ওমর

ইসরাইলের উচিত আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব বন্ধ করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেয়া এবং প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে শান্তিতে বসবাস করা। স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসরাইলের জন্য একমাত্র সমাধান। ফিলিস্তিনিদেরকে ত্রাণ নয়, স্বাধীনতা দিন। নিজের দেশে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ দিন। দুই রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া ফিলিস্তিন বা ইসরাইল কারো জন্যই শান্তির সম্ভাবনা নেই। এই সত্য ইসরাইল এবং তার মিত্রদের অনুধাবন করতে হবে। আমরা সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এই আশা করি
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই গাজা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা পেশ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার মানুষ অন্য দেশে চলে যাবে এবং গাজাকে তিনি অত্যাধুনিক পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। ইসরাইল এ পরিকল্পনা সমর্থন করে। হামাসসহ মুসলিম দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করে। গাজা থেকে গাজাবাসীকে উৎখাত করে অন্যত্র পুনর্বাসনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চরম লঙ্ঘন। বিষয়টি অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয়, বেআইনি ও অযৌক্তিক। গাজায় বসবাসরত মানুষগুলো গাজাতেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং বড় হয়েছে। গাজা তাদের জন্মভূমি ও মাতৃভূমি। পৃথিবীর ১৯৩টি দেশের ৮০০ কোটি মানুষের মতো গাজার মানুষগুলো তাদের নিজ ভূমি গাজাতেই বসবাস করবে এবং এটিই স্বাভাবিক। গাজায় বসবাস গাজাবাসীর জন্মগত অধিকার এবং জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের উচিত মানবতাবিরোধী এই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে গাজার পুনর্গঠন এবং গাজাবাসীর সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করা।
ইসরাইলের দীর্ঘ আগ্রাসন এবং অবরোধের প্রতিবাদে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু ইসরাইলি মারা যায় এবং কিছু বন্দী হয়। তারপর থেকেই ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে হামলা চালায়, যাতে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং লক্ষাধিক আহত হয়। ইসরাইলি হামলায় হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং পরবর্তী প্রধান ইয়াহিয়া সিনাওয়ারসহ অনেক শীর্ষ নেতা মারা যান। ইসরাইলি হামলায় গাজার বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ-গির্জা ও হাসপাতাল মাটিতে মিশে গেছে। গাজার বেশির ভাগ মানুষই এখন উদ্বাস্তু এবং ত্রাণের খাবার খেয়ে তাঁবুতে বসবাস করছে। ১৯ জানুয়ারি থেকে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ফলে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের আপাতত অবসান হয়। কিন্তু এর পরও ইসরাইল বিভিন্ন সময়ে গাজায় হামলা চালিয়ে কয়েক শত মানুষকে হত্যা করেছে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাবাসীকে গাজা থেকে সরিয়ে অন্য দেশে পুনর্বাসন এবং গাজাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ার প্রস্তাব দেন, যা গাজাবাসীকে সমূলে নির্মূলেরই পরিকল্পনা।

গাজার চার হাজার বছরের ইতিহাস আছে। গাজা ৩৫০ বছর প্রাচীন মিসরের অধীন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩০ সালে গাজা আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে গাজা দখল করে। আমর ইবনুল আস ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে গাজা বিজয় করে এবং তার শাসনামলে অধিকাংশ গাজাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমীয়দের শাসন থেকে ফ্রান্সের খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। সালাউদ্দিন আইয়ুবি ১১৮৭ সালে তাদের বিতাড়িত করে গাজা জয় করেন। ১৬ শতাব্দী হতে গাজা অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা গাজা দখল করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার বেলফার ইহুদিদের জন্য আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিন প্রস্তাবটি জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করে এবং ৩১ আগস্ট ফিলিস্তিনবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ কমিটি ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্তির সুপারিশ করে। ২৯ নভেম্বর প্রস্তাবটি জাতিসঙ্ঘে গৃহীত হয়। এতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৫ শতাংশ ইহুদি রাষ্ট্র এবং ৪৫ শতাংশ আরবদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তখন ফিলিস্তিনে আরব ছিল ১২ লাখ ৬৯ হাজার, ইহুদি ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার। ১৯৪৮ সালে ১৫ মে ছিল ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অবসানের দিন এবং আগের দিন ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বেন গুরিয়ান ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্তালিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তৎক্ষণাৎ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেন। এভাবেই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম। বিভক্তির পরপরই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ে ১০ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলি হামলায় আরব বাহিনী পরাজিত হয়। অক্টোবরে ইসরাইল উত্তর লেবাননের সীমান্তও গোলান মালভূমিতে এবং দক্ষিণ আকাবা উপসাগর ও সিনাই উপত্যকায় হামলা চালায়। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরাইল আরব রাষ্ট্রসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং এক সপ্তাহের যুদ্ধে ফিলিস্তিনের গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুসালেম, মিসরের সিনাই এবং সিরিয়ার গোলান উপত্যকা দখল করে নেয়। এভাবে গাজা ইসরাইলের অধীনস্থ হয়।

ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ পিএলও দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছে। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইসরাইলের সাথে পিএলও চুক্তি করে, যা অসলো শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত এতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটির মাধ্যমে পিএলও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়, যা হামাস প্রত্যাখ্যান করে। হামাসের উত্থানে ফিলিস্তিনের রাজনীতি পাল্টে যায়। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ, অপরদিকে ইসলামপন্থী হামাস। ফাতাহর পক্ষে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। হামাস ইসরাইলের ঘোরবিরোধী। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য ফাতাহ সশস্ত্র সংগ্রামকে পরিত্যাগ করেছে আর হামাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে চায়। ইসরাইলের অস্তিত্ব ফাতাহ স্বীকার করে, হামাস করে না। ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হামাস ১৩২টি আসনের ৭৬টিতে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব ইসলামপন্থীদের হাতে যাওয়ায় ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা হামাসকে বয়কট এবং ফিলিস্তিনে সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর হামাস নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধে মার্কিন কংগ্রেসে প্যালেস্টাইনিয়ান এন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট-২০০৬ নামের বিল পাস হয়। ২০০৭ সালের ১৪ জুন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাস সরকারকে বরখাস্ত এবং হামাস ওই দিন গাজা দখল করে। তখন থেকেই গাজায় হামাসের এবং পশ্চিম তীরে ফাতাহর শাসন চলছে। ইসরাইল সে দিন থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

ইসলামের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন গড়তে ১৯৮৭ সালে শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিসি ও খালেদ মোশলেরা হামাস প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠা থেকেই হামাস মোকাবেলা করেছে ইসরাইলের অব্যাহত দমন নির্যাতন, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা সমর্থন করেছে। কিন্তু সব প্রকার দমন-নিপীড়ন মোকাবেলা করে হামাস সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। হামাসের ওপর যত নির্যাতন এসেছে, তারা তত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হামাসের অর্ধশতকেরও বেশি নেতাকে প্রায় ২৫ বছর আগে ইসরাইল বহিষ্কার করে, যারা দীর্ঘদিন নোম্যান্স ল্যান্ডে তাঁবু বানিয়ে বসবাস করেছিল। কিন্তু আপস করেনি। ইসরাইল বিভিন্ন সময়ে শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিসি, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনাওয়ার, মুহাম্মদ দেইফসহ অসংখ্য শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু হামাস নির্মূল হয়নি। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য হামাস আপসহীনভাবে লড়ছে। সাম্প্রতিককালে গাজাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা এবং গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস করে ও হামাসকে নির্মূল করা যায়নি। ইসরাইলকে শেষ পর্যন্ত হামাসের সাথেই যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে হয়েছে। হামাসই এখন ইসরাইলের প্রধান প্রতিপক্ষ।

৩৬৫ কিলোমিটার আয়তনের গাজায় প্রায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের ৯৮ শতাংশই মুসলমান। ছোট একটি ভূখণ্ডের সামান্য কিছু মানুষকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মাথাব্যথার প্রকৃত কারণ কী? ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনিরা সবই হারিয়েছে। কিন্তু গাজা ছেড়ে যায়নি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা গাজাতেই আছে। হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছে কিন্তু ইসরাইলের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। অন্য দেশে পুনর্বাসিত হয়ে বিলাসী জীবন গ্রহণেও রাজি নয়; বরং জন্মভূমি গাজায় কষ্ট হলেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে প্রস্তুত। সুতরাং গাজার মানুষ অন্য কোথাও যাবে না। দমন-নির্যাতনের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইসরাইল হামাসকে নির্মূল এবং গাজার নেতৃত্ব থেকে উৎখাত করতে পারেনি। তাই গাজার সব মানুষকে অন্য দেশে সরিয়ে গাজাকে ফিলিস্তিনি মুক্ত করে ইসরাইল তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান লড়াইকে চিরতরে নির্মূল করতে চায়। ইসরাইল এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে চিরতরে দমন করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের এ আশা পূরণ হবে বলে মনে হয় না। ইসরাইলের উচিত আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব বন্ধ করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেয়া এবং প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে শান্তিতে বসবাস করা। স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসরাইলের জন্য একমাত্র সমাধান। ফিলিস্তিনিদেরকে ত্রাণ নয়, স্বাধীনতা দিন। নিজের দেশে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ দিন। দুই রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া ফিলিস্তিন বা ইসরাইল কারো জন্যই শান্তির সম্ভাবনা নেই। এই সত্য ইসরাইল এবং তার মিত্রদের অনুধাবন করতে হবে। আমরা সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এই আশা করি।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়নকর্মী
omar_ctg123@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/printed-edition/KuLh5uhTwe4F/