১৫ মার্চ ২০২৫, শনিবার

সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প : ৭ বছর পর ব্যয় কমলো ৪২৫ কোটি টাকা

সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কেনাকাটায় চলে যত লুটপাট। এইসব প্রকল্পের অর্থ লুট করেই একশ্রেণীর ঠিকাদার, আমলা ও রাজনীতিবিদরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। উন্নয়ন না হলেও উন্নয়ন কর্মসূচির আকার প্রতি বছরই বড় হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছু প্রকল্প সংশোধনে এসেই থলের বিড়াল বের হচ্ছে। এর মধ্যে সমীক্ষা ছাড়াই সাত বছর আগে ১০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকায় অনুমোদন দেয়া হয় বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের। মেয়াদ বাড়াতে এসে মূল্যায়ন কমিটির কাছে ৪২৫ কোটি টাকার ঘাপলা ধরা খেলো। এই সাত বছরেও অনেক স্কুলের কাজ শুরুই হয়নি। এখন কমে গেলো প্রকল্প ব্যয়ের ৪২৫ কোটি টাকা পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে টিআইবির গবেষণা বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্টে ১২টি প্রধান ঠিকাদারি সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে।

প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ১০টি করে তিন শ’ আসনে মোট তিন হাজার স্কুল নির্বাচন করা হয়। সারা দেশের তিন হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প অনুমোদন দেয় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। ওই প্রকল্পের ব্যয় সে সময় ধরা হয় ১০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। তবে এই প্রকল্পের জন্য কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি। যেখানে শত কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্প হলেই সমীক্ষা বাধ্যতামূলক। তিন হাজার স্কুলের জন্য আসবাব কেনা এবং ভবন নির্মাণ চার থেকে মানভেদে ছয়তলা। মূল খরচ এখানেই। সরকার পতন না হলে এই ৪৩৫ কোটি টাকা সিন্ডিকেটের পকেটেই চলে যেত। খরচ আগেই বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। এরপর শুধু দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য বলছে, মানসম্মত শিক্ষা এবং ভৌত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, প্রচলিত মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (বেসরকারি) ছাত্রছাত্রীদের চাপ কমানো প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এই কাজের মধ্যে রয়েছে, শহর ও গ্রামীণ এলাকায় চারতলার ভিত্তিসহ চার তলা এবং ছয়টি মহানগর এলাকায় ছয় তলার ভিত্তিসহ ছয় তলা ভবন নির্মাণ করা। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে হিসেবে পাঁচ তলা ভিত্তিসহ পাঁচতলা ভবন নির্মাণ। প্রতিটি নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্র সরবরাহ করা। মাধ্যমিক স্তরে ভৌগোলিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করা। শিক্ষানীতির বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুমোদিত মূল ডিপিপিতে পিডব্লিউডি ২০১৪-এর রেট শিডিউলের ভিত্তিতে নির্মাণকাজের প্রাক্কলন প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৯২.৬৪ শতাংশ। বর্তমানে ২ হাজার ৪৪০টি ভবনের কাজ ১০০ শতাংশ, ৫১১টি ভবনের কাজ এক থেকে ৯৯ শতাংশ। বর্তমানে সারা দেশে নির্মাণকাজ পিডব্লিউডি ২০২২ (সংশোধিত) এর রেট শিডিউলের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই প্রকল্পে যেসব প্রতিষ্ঠানে নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ এখনো শুরু হয়নি। যে সব কাজ বন্ধ রয়েছে সে সব প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র সরবরাহ করার ব্যয় পিডব্লিউডি ২০২২ (সংশোধিত) এর রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রাক্কলন করে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্প শুরুর সোয়া সাত বছরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নাম পাওয়া যায়নি। আর ২৪টি বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি। ফলে এগুলো এখন বাদ দিতে হচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতির মধ্যে ৯ হাজার ৬১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এখানে ক্যাটাগরি-১ এ শহর ও গ্রামের সমতল এলাকায় ২ হাজার ৩৫৯টি বিদ্যালয়, ক্যাটাগরি-২ এ বিভাগীয় শহরে ২৩৩টি, ক্যাটাগরি-৩ এ পাহাড়ি এলাকায় ৪৪টি, ক্যাটাগরি-৪ এ উপকূলীয় এলাকায় ৯১টি, ক্যাটাগরি ৫-এ হাওর ও বিল এলাকায় ৩২টি এবং ২০৯টি লবণাক্ত এলাকার বিদ্যালয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যানাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এই প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার এক দশকে তাদের বাজার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তিমূল্যের ৭৪.৯৬ শতাংশ কাজ করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ঠিকাদারদের দখল ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যতম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্টে ১২টি প্রধান ঠিকাদারি সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি ক্রয়খাত সারাবিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ, তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারিত্বের হাতে জিম্মি দশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য মোট ক্রয় বাজেটের ২৭ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। প্রত্যাশা ছিল ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে, সরকারি ক্রয়খাতে দুর্নীতি কমবে এবং ব্যয়িত অর্থের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি বরং ইলেক্ট্রনিক ক্রয়ব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।

গত ৫ মার্চ প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হয়। এ ব্যাপারে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগমের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে চাননি।
আর প্রকল্প পরিচালক শাহ নইমুল কাদেরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/printed-edition