১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার

বাস্তবতার নিরিখেই ঘুরে ফিরে আসে অধ্যাপক গোলাম আযমের স্বপ্নের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’

বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবশেষে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে সংবিধানে এই ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। গত মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ বিষয়ে রিটের শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে। এর আগে ৪ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা প্রশ্নে রিটের শুনানি শেষ হয়। এই রায়ের পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতার নিরিখেই ঘুরে ফিরে আসছে অধ্যাপক গোলাম আযমের স্বপ্নের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পটভূমি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ সরকারের পতন ও পদত্যাগের সময় যে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়- তা নিরসনে এইরূপ একটি অস্থায়ী সরকার গঠন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তৎকালীন সরকারবিরোধী জোটের রূপরেখা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তখনকার মতো এই সরকারের পর্ব সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন (১৯৯১-৯৫) বিরোধী দল কতকগুলো দাবিকে সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে এবং একই সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালনার দাবি জানায়। কিন্তু সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক বলে অগ্রাহ্য করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করে। কিন্তু সকল দল নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা প্রতিহত করারও ঘোষণা দেয়। বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করায় এই নির্বাচন জনগণের নিকট গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করেনি। ফলে উদ্ভূত গণ আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠন আইন পাশ করে। এই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার মূল ফর্মূলা প্রদান করে জামায়াতে ইসলামী। পরবর্তীকালে কয়েকটি পর্বে এই দাবিতে আন্দোলনটি পরিচালিত হতে থাকে। বলা যায়, চতুর্থ পর্বে গিয়ে এটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। কেয়ারটেকার-এর প্রথম পর্ব বাংলাদেশে কেয়ারটেকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রথম প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি। জামায়াতের তৎকালীন আমীর বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গোলাম আযম সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রথম কেয়ারটেকার সরকার সংক্রান্ত একটি রূপরেখা জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিবেশনে পেশ করেন। ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান রমনা গ্রীনে আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই রূপরেখা প্রকাশ করেন। এবিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, “গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকারই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় নেতা হওয়ায় সরকার পরিচালনার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার সম্ভাবনা থাকে। ব্রিটেনে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে এমন সুযোগ গ্রহণ না করলেও আমাদের দেশে এর সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। এ ভাবনা থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি ‘কেয়ারটেকার সরকার’ পরিভাষার আবিষ্কারক নই। এ পরিভাষা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেই আমি পেয়েছি। আমার প্রস্তাবে শুধু ‘নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সরকারের’ পরিচালনার কথাটুকুই নতুন সংযোজন বলা যায়। প্রস্তাবনার মূল কথা ছিল: “নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত (অবসরপ্রাপ্ত নয়) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এমন লোকদেরকে নিয়োগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। এ সরকার নিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ সরকার কায়েম থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি নিজ পদে প্রত্যাবর্তন করবেন। মূল প্রস্তাবে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রধান করার কথা এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তিনি নির্বাচনের পরই পূর্বপদে ফিরে যাবেন বলে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সুযোগ থাকবে না। এ অবস্থায় তাঁর কোন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কোন আশংকা থাকবে না। ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বরে রাজধানীর রমনা গ্রীণে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিহত করার ফলে ঐ বছর নবেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন। ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের ধারা স্তব্ধ করে দেন। ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে রাজনৈতিক দলসমূহকে সক্রিয় হবার সুযোগ দিলে ঐ বছরই ২০ নবেম্বর বায়তুল মোকাররামের দক্ষিণ চত্ত্ব¡রে জামায়াতের জনসভায় একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসাবে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়।” কেয়ারটেকার-এর দ্বিতীয় পর্ব অতঃপর এটি দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করে। এবিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম উল্লেখ করেন, “১৯৮৩ সালেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট ও বিএনপি’র নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী পৃথক পৃথকভাবে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে মুলতবি শাসনতন্ত্র বহাল করার আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন যুগপতের রূপ নিলে ১৯৮৪ সালের শুরুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। সামরিক শাসক এপ্রিল মাসে ১৫ দল, ৭ দল ও জামায়াতকে তাঁর সাথে সংলাপের আহবান জানান। যুগপৎ আন্দোলনের ফলে উভয় জোট নেত্রীর সাথে যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, জামায়াত সে সুবাদে ১৫+৭+জামায়াত মিলে ২৩ দলের একসাথে সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। জামায়াত সংলাপে পেশ করার দাবিটি লিখিত আকারে দুনেত্রীকে দেবার পর তারা কেউ তা পছন্দ করলেন কিনা জানা গেল না। ১০ এপ্রিল জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীরের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের ডেলিগেশন জেনারেল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ঐ লিখিত দাবিটি পেশ করে যা দুজোট নেত্রীকে দেয়া হয়। কেয়ারটেকার-এর তৃতীয় পর্ব অধ্যাপক গোলাম আযম প্রদত্ত বিবরণে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে সাথেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাঙা হয়ে উঠে। কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সুনির্দিষ্ট দাবি সর্বমহলে সহজে বোধগম্য হওয়ায় স্বৈরশাসনের অবসানের পথ সুগম হয়। কিভাবে সরকার পরিবর্তন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দাবি উত্থাপিত হওয়ায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার হয়। এ সময় ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো ১৫ দলীয় জোটের কয়েকটি বাম দল ৫ দলীয় জোট গঠন করে। এতোদিন সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাদের কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেয়া ফর্মূলা অনুযায়ীই ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় জোটের নামে একটা রূপরেখা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির হাতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত (মন্ত্রীর মর্যাদায়) উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এ নবগঠিত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। এবার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হলো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো। বাধ্য হয়ে এরশাদ ৬ ডিসেম্বর (১৯৯০) পদত্যাগ করলেন। কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলন সফল হলো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) ঐ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। কেয়ারটেকার-এর চতুর্থ পর্ব কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয় মূলত বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকা কালে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে না যাবার ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় জুন মাসে বাজেট সেশনেই জামায়াতে ইসলামীর পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করার জন্য একটি বিল জমা দেন। পরে ঐ বছরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এ বিষয়ে মোটেই আগ্রহী ছিল না। ফলে আবারো কেয়ারটেকার সরকার দাবিতে আন্দোলন করতে হলো। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার দাবি নিয়ে ১০ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) আন্দোলন করেছে। ১৯৯০ সালে বিএনপিও এ আন্দোলনে শরিক ছিল। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুবাদেই তাঁরা ক্ষমতায় গেলেন। অথচ এ পদ্ধতিটি সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দিলো না। ফলে আন্দোলন হলো এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকার কেয়ারটেকারের দাবি মেনে নিয়ে সংবিধানে তা যুক্ত করে। এর পরবর্তী পর্যায়ে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মেয়াদ শেষে পরবর্তী অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে। সপ্তম জাতীয় সংসদের মেয়াদ ২০০১ সালের ১৩ জুলাই শেষ হয়। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১ অক্টোবর (২০০১) জাতীয় সংসদের নিবার্চনের তারিখ ঘোষণা করেন। নির্বাচনে চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। কেয়ারটেকারের বিপর্যয় পর্ব ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বহুল আলোচিত সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতাসীন ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন নেতৃত্বাধীন জরুরি সরকারের অধীনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্কের জের ধরে যথাসময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ-এর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নবম জাতীয় সংসদে সংসদ নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা, আর বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী জোট সরকার প্রথমে উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আইনবহির্ভূত ঘোষণা করায় এবং পরে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এটি সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করে। আওয়ামী জোট সরকার সংবিধানে সংশোধনী এনে একাধারে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদে এবং দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভা এবং পূর্ববর্তী নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বহাল রেখে, নিজেদের সুসজ্জিত প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও সহকারীদের সহায়তায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার যাবতীয় ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নেয়। এর পর আরো তিনটি নির্বাচন অতিক্রম করে এবং বিপুলভাবে বিতর্কিত সব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার একতরফা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ ১৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পর চব্বিশের সফল গণ-অভ্যূত্থানের প্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা পুনরায় সংবিধানে সংযোজিত হলো। বিশ্লেষকরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মনে করেন, ১৯৯১ সালের বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নিরপেক্ষ সরকার আর ১৯৯৫-৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সকলেরই সম্মিলিত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই। আর এই সরকার ব্যবস্থার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম এবং সম্মুখ সারিতে থেকে এর নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ হয়ে আছে বলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন।

https://www.dailysangram.com/post/576478