১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন

গোপন বন্দিশালা থেকে ‘মুক্তি’ ঘটত সাজানো মামলার আসামি হয়ে

গুমের শিকার হওয়ার পর যেসব ব্যক্তি জীবিত ফিরে এসেছেন, তাঁরা নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদ ও দীর্ঘদিন গোপন বন্দিশালায় আটকে থাকার পরও ছাড়া পাননি। একপর্যায়ে গোপন বন্দিশালা থেকে তাঁদের বের করার পর সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
গুমসংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ তথ্য রয়েছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয় কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার হওয়া অনেক ব্যক্তি কমিশনকে বলেছেন, তুলে নেওয়ার পর গোপন বন্দিশালায় দিনের পর দিন নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদ ও দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। পরে যাঁদের হাতে বন্দী ছিলেন, তাঁরাও স্বীকার করতেন যে তাঁরা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু এরপরও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো। এ ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল, আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই গুমের শিকার ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সামনেই এ কথা বলা হতো। গুমের মতো বেআইনি কাজ ধামাচাপা দিতে ভুক্তভোগীদের সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার অনেক ব্যক্তিকে ভিত্তিহীন অভিযোগে পুলিশের হাতে সোপর্দ অথবা আদালতে হাজির করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (পরে যা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন) ভিত্তিহীন মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের কারসাজি শুধু গুমের প্রকৃতি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করেনি, পাশাপাশি এতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ, গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও মিথ্যা মামলা ও ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার কারণে বছরের পর বছর ধরে এসব মানুষকে হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে এ ধরনের শত শত ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা যেমন ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে, তেমনি এর সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনী জড়িত ছিল। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কীভাবে মিথ্যা মামলা সাজানো হতো, এসব ঘটনা থেকে তা উঠে এসেছে।

গুমের ঘটনা নিয়ে তদন্ত এখনো চলমান থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, এসব ঘটনা নিয়ে আরও তদন্ত করে ভবিষ্যতের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।

তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতন শেষে গোপন বন্দিশালা থেকে বাইরে আনার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির করা হতো। তখন তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সাজানো গল্প বলা হতো। এসব অভিযোগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুলে বা সত্যতা যাচাই না করে সেগুলো নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক খবর প্রকাশের কারণে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারকে সমাজে চরম অবমাননার শিকার হতে হয়েছে। অনেক ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন জানতে পেরেছে, অভিযোগ মিথ্যা হওয়ার পরও এসব কারণে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারকে সমাজ থেকে একঘরে হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

এসব ঘটনার উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, এতে করে একটা বিষয় উঠে এসেছে যে এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোর আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা নিয়ে নিজেদের ভুল সংশোধনে নিজেদের কাজ পর্যালোচনা করা।

বিচারব্যবস্থায় ঘাটতি
গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার বড় ঘাটতি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কর্তব্যে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রায়ই যথাযথভাবে যাচাই বা ভুক্তভোগী/অভিযুক্তদের প্রশ্ন না করেই এসব বক্তব্য রেকর্ড করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যা বলত, সেটাই রেকর্ড করা হতো।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গুমের সঙ্গে যে কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তাঁকেই ভিত্তিহীন এসব মামলার তদন্ত কর্মকর্তা করা হতো। এতে গুমের শিকার ব্যক্তি সেই একই বাহিনীর সদস্যদের হাতে আবারও হেফাজতে থাকতেন এবং সেই বাহিনীর কর্মকর্তারাই তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। এতে করে ভোগান্তি বাড়ত এবং তাঁরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কোনো অভিযোগ না এনে গুমের শিকার কিছু কিছু ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা একাধিকবার গুমের শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দুই বা তিনবার গুমের শিকার হয়েছেন, এমন ঘটনাও পেয়েছে কমিশন। এসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার গুমের সময় কখনো কখনো তাঁদের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত নেওয়া হয় যে তাঁরা ভবিষ্যতে কখনো রাজনীতি করবেন না এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকবেন।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/9p7nz6s44i