চিকিৎসা, ভ্রমণ এবং কেনাকাটায় ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশীরা। বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ডকে বেছে নিচ্ছেন তারা। এটি কেবল ধারণা নয়, এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশীদের লেনদেন ভারতের পরিবর্তে এখন থাইল্যান্ডেই বেশি হচ্ছে। দেশটিতে এক মাসের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশীদের খরচ বেড়েছে ১৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশীরা ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছিলেন ৪২ কোটি টাকা। অক্টোবরে এই খরচ এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ কোটি টাকায়, যা একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয়। এক মাসের ব্যবধানে থাইল্যান্ডে লেনদেন বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা আগে ছিল ভারতে। প্রথম থেকে তৃতীয় অবস্থানে নেমে এসেছে ভারত। অক্টোবর মাসে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের তথ্য নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে বাংলাদেশীদের জন্য পর্যটক ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। ভিসা কবে চালু হবে এ বিষয়ে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক ভারতের কলকাতা, দিল্লি, দার্জিলিং, সিকিম, শিলং ইত্যাদি এলাকায় যেতেন। কিন্তু ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশে বাংলাদেশীদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগে বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশীরা ভারতে গিয়ে সব থেকে বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতেন। কারণ প্রতি বছরই চিকিৎসা, কেনাকাটা ও ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে অসংখ্য বাংলাদেশী ভারতে যান। ফলে ক্রেডিট কার্ডে ভারতেই সব থেকে বেশি খরচ করতেন বাংলাদেশীরা। এখন সেই জায়গা দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ড। ক্রেডিট কার্ডে ভারতে বাংলাদেশীদের ব্যয় তিন নাম্বারে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী ৪৪টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং দেশের ভেতরে বিদেশী নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশে-বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে এক মাসের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডে খরচ বেড়েছে ১৯৭ কোটি টাকা বা প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। আর বিদেশে খরচ বেড়েছে ৭৮ কোটি টাকা বা সাড়ে ১৮ শতাংশের বেশি।
গত অক্টোবরে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে খরচ করা হয়েছে ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। আর অক্টোবরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশীরা খরচ করেছেন ৪৯৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ৪২১ কোটি টাকা। বিদেশে বাংলাদেশী ক্রেডিট কার্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার এখন যুক্তরাষ্ট্রে। অক্টোবরে দেশটিতে খরচ হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী ক্রেডিট কার্ডে খরচ বেড়েছে ৭ কোটি টাকা বা সোয়া ৮ শতাংশের বেশি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টের পটপরিবর্তনের আগে চিকিৎসা ও ভ্রমণে বাংলাদেশীদের অন্যতম গন্তব্য ছিল ভারত। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর ভিসা প্রদানে কড়াকড়ির কারণে দেশটিতে বাংলাদেশীদের ভ্রমণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। ফলে দেশটিতে কমে গেছে বাংলাদেশীদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারও। তার বদলে চিকিৎসা ও ভ্রমণের জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশীরা ক্রেডিট কার্ডে যত অর্থ খরচ করেন, তার ২৮ শতাংশের বেশি বা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে। অক্টোবরে বিদেশে খরচ হওয়া ৪৯৯ কোটি টাকার মধ্যে ১৪১ কোটি টাকায় খরচ হয়েছে এই দুই দেশে। ক্রেডিট কার্ডে খরচের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে ছিল ভারত। দেশটিতে অক্টোবরে বাংলাদেশীরা খরচ করেছেন ৫৪ কোটি টাকা, যা আগের মাসের চেয়ে চার কোটি টাকা বেশি।
বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে খরচের দিক থেকে থাইল্যান্ডের পর বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিঙ্গাপুরে। দেশটিতে অক্টোবরে বাংলাদেশীরা খরচ করেছেন ৪৩ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে দেশটিতে ক্রেডিট কার্ডে খরচ ১৩ কোটি টাকা বেড়েছে। এ দিকে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশীদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশীদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে। গত অক্টোবরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশীরা ক্রেডিট কার্ডে ১২৯ কোটি টাকা খরচ করেছেন। সেপ্টেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ১১১ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে বিদেশীদের খরচ বেড়েছে ১৮ কোটি টাকা বা সোয়া ১৬ শতাংশ। এ দেশে বিদেশীরা ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি করেন নগদ অর্থ উত্তোলনে। অক্টোবরে ১২৯ কোটি টাকা খরচের মধ্যে ৪৭ কোটি টাকাই বিদেশীরা উত্তোলন করেছেন নগদ।