চাহিদামতো কাগজ না পাওয়ায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে। বছরের এই সময়ে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান যেখানে রাত-দিন বই ছাপার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে কাগজ সঙ্কটে দিনে-রাতে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টাও কাজ করতে পারছেন না তারা। ২০২৫ সালের জন্য প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের ৪০ কোটির বেশি বই ছাপার টার্গেট থাকলেও মিল থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ না আসায় বেশির ভাগ প্রেসে অলস সময় কাটাচ্ছেন মুদ্রণকাজের সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা।
এ দিকে বিভিন্ন প্রেসমালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সাথে চুক্তি মোতাবেক তাদেরকে পাঠ্যবই ছাপার জন্য যে সময় নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে সে মোতাবেক সবধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তরের প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬৪৭ কপি বই ছাপার জন্য ৪১টি প্রেস চুক্তিবদ্ধও হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর বই ছাড়া অন্য কোনো ক্লাসের বই বিশেষ করে চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবই এখনো ছাপার কাজ শুরুই হয়নি। অন্য দিকে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার জন্য কয়েকটি চুক্তি হলেও সেই বই ছাপার কাজ এখনো শুরু করতে পারেনি অনেক প্রেসমালিক।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপতে কাগজের ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) এবং বাস্টিং কাগজের (স্ট্র্যান্থ) নির্ধারিত একটি পরিমাণ রয়েছে। আর এই নির্দিষ্ট পরিমাণের কাগজ সব মিল উৎপাদনও করতে পারে না। বিশেষ করে চারটি কাগজ মিল থেকেই প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার জন্য কাগজ সরবরাহ করা হয়। মিলগুলো হচ্ছে- তানাকা পেপার মিল, ফ্রেশ পেপার মিল, আম্বার পেপার মিল এবং লিপি পেপার মিল। যদিও বসুন্ধরা পেপার মিল আগে এই কাগজ সরবরাহ করত; কিন্তু কাগজের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পরিমাণে কিছু জটিলতা থাকায় তারাও এবার কাগজ দিচ্ছে না। ফলে মূলত চারটি পেপার মিল থেকেই প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার জন্য কাগজ নিচ্ছেন প্রেসমালিকরা।
অন্য দিকে কাগজ সঙ্কটের কারণে পাঠ্যবই ছাপা বন্ধের উপক্রম হয়েছে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে এনসিটিবি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন একাধিক প্রেসমালিক। চিঠিতে তারা জানিয়েছেন, প্রেসগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও শুধু কাগজের সঙ্কট থাকায় বই ছাপায় বিঘœ ঘটছে। দ্রুত এই সঙ্কট সমাধান করা না গেলে যথাসময়ে বই মুদ্রণ করে তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে। এ জন্য প্রেসমালিকরা এনসিটিবিকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ারও অনুরোধ জানিয়েছেন।
গতকাল পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজে জড়িত বড় পরিসরের বেশ কয়েকটি প্রেসের মালিক নয়া দিগন্তকে জানান, তারা বই ছাপার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু কাগজের সঙ্কটের কারণে উৎপাদন বন্ধ। বেশ কয়েকটি প্রেস দিনে শুধু দুই থেকে তিন ঘণ্টা বই ছাপতে পারছে। গত কয়েকদিনে এনসিটিবিতে এসে কাগজ সঙ্কটের কথা জানিয়েছেন এমন প্রেসমালিকদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্ট মাস্টার, সরকার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, মৌসুমী প্রিন্টার্স, আনন্দ প্রিন্টার্স, হাওলাদার প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেড প্রভৃতি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রেসমালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, পাঠ্যবই ছাপার কাজে সবধরনের প্রস্তুতি থাকলেও একটি জায়গায় এসে আটকে আছি। বই ছাপার জন্য মূল উপকরণ সেই কাগজই যদি অগ্রিম টাকা দিয়েও সময়মতো না পাই তাহলে বই ছাপা বন্ধ রাখতে আমরা বাধ্য হয়েছি। অভিযোগ রয়েছে লিপি পেপার মিল এবং রশিদ পেপার মিলে অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেক প্রেসমালিক সময়মতো কাগজ পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে রশিদ পেপার মিলের মালিক আব্দুর রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। একই বিষয়ে লিপি পেপার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মতিন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের মিলের একটি মেশিনে সমস্যা থাকায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। তবে এখন আবার পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণেও আমাদের উৎপাদনে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। আশা করছি নিয়মিত কাগজ সরবরাহ করতে পারব।
পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, বই ছাপা বা উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে কাগজের সঙ্কট রয়েছে এটা সত্য। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই কাগজের সঙ্কট যাতে সমাধান করা যায়। অবশ্য আমরা কাগজের মিলমালিকদের সাথেও যোগাযোগ করছি। প্রয়োজনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে হলেও আমরা চেষ্টা করছি প্রেসমালিকরা যাতে তাদের চাহিদামতো কাগজ সময়মতো পান এবং পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে পারেন।