১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ৪:১৫

তিস্তার গতিপথ বন্ধ করে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প

নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে, ভাঙছে সমতল ভূমি

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তিস্তার চরে ‘লাঠশালায়’ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প‘ তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড’ প্রকল্প। তিস্তার গতিপথ বন্ধ করে নদী সমীক্ষা ছাড়াই এ প্রকল্প গড়ে ওঠায় তিস্তার ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ১৬শ একর জমিতে গড়ে তুলেছেন এ বিশাল সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কোনো অনুমতি না নিয়ে নদী গবেষকদের সমীক্ষা ছাড়াই ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু করা হয়। তিস্তা নদীপথে বাধা সৃষ্টি করে অপরিকল্পিতভাবে ৬৫০ একর সরকারি জমি লিজ নিয়ে এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ৯৫০ একর জমি কিনে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে ভয় দেখিয়ে কম দামে এবং বিনিময়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ক্ষমতার জোরে পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত হাইভোল্টেজের ২৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়। কথা ছিল যাদের জমির ওপর দিয়ে হাইভোল্ডেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হবে, তাদের আর্থিক ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি।

তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রকল্পটির বিপরীতে ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। কাগজপত্রে ‘তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড’ সরকারি ঋণ সহায়তায় পীরগাছা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী চর লাটশালায় তিস্তা নদী অববাহিকার পরিত্যক্ত ও অকৃষি সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে নির্মিত নবায়নযোগ্য বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান বলা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হিসাবে সালমান এফ রহমানের ছেলেকে দেখানো হয়েছে। প্রকল্পটিতে সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকো কেম্পানির কোনো সংশ্লিষ্টাতা নেই বলে দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর মালিক সালমান এফ রহমান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ২৮ মার্চ রংপুরে ১৪ দলের মহাসমাবেশে এসে ভার্চুয়ালি প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন এবং হেলিকপ্টারে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন।

আরও অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পটি নির্মাণের সময় স্থানীয় অনেক ঠিকাদার বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ ও জনবল সংগ্রহ করে দিলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। মালামাল সরবরাহকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এসব বিষয়ে পুলিশের কাছে একাধিক অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি।

ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অভিযোগকারীদের দমিয়ে রাখা হয় বলে সোহাগ মিয়া নামের ভুক্তভোগী এক ঠিকাদার এ প্রতিবেদককে জানান। তিনি আরও জানান, স্থানীয়ভাবে সমঝোতার মাধ্যমে অর্ধেকেরও কম বিল দেওয়ায় তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি জানান, একইভাবে এলাকার অনেক ঠিকাদার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ ঋণ নিয়ে ওই প্রকল্পে মালামাল সরবরাহ করে টাকা না পাওয়ায় পাওনাদারদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তিস্তার চর লাঠশালার জাকির হোসেন নামের এক কৃষক জানান, তাকে তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেডে চাকরি দেওয়া হবে বলে প্রলোভন দেখিয়ে তার ৩ একর জমি নামমাত্র মূল্যে লিখে নেয় সালমান এফ রহমানের লোকজন। প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর তাকে আর চাকরি দেওয়া হয়নি। একইভাবে সালমান এফ রহমানের লোকজন চর লাঠশালাসহ এর আশপাশের চরের শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে তিন ফসলি আবাদি জমি লিখে নিয়েছেন, এর পরিমাণ প্রায় ৯৫০ একর। এ সম্পর্কে ওই প্রকল্পের ম্যানেজার সাব্বির আহমেদ জানান, তাদের প্রকল্পের উৎপাদিত ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজের কোনো বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, যা দেখছেন সবই দৃশ্যমান।

নদীর অববাহিকায় কোনো অবকাঠামো বা প্রকল্প স্থাপন করতে গেলে নদী কমিশনের কারিগরি টিমের সমীক্ষা প্রতিবেদন জরুরি কিনা? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তারাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে এ কারণে তাদের কাছে ওই প্রকল্প নিয়ে কোনো তথ্য নেই। এ প্রকল্পের কারণে রংপুরের ভাটিতে তিস্তার ভাঙন প্রবল হয়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তার ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলার তিস্তার অববাহিকায় সমতল ভূমি, আবাদি জমি, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ভাঙনের মুখে পড়েছে। ক্রমাগত ভাঙন বাড়ছে। তিনি দাবি করেন, আগামী দিনে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

নদী বিশেষজ্ঞ ও রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে তিস্তার বুকে, যা তিস্তার জীবসত্তাকে ধ্বংস করার শামিল। তিনি আরও বলেন, এ কারণে তিস্তার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হওয়ায় উলিপুর ও রাজারহাট এলাকায় তিস্তার ভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে।

https://www.jugantor.com/tp-lastpage/850762