১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ৪:১২

পলকের ঝলকে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার হয়েছিল দুর্নীতির আখড়া

ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঝলকে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার হয়েছিল দুর্নীতির আখড়া। বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানির অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া সচিব এ কে এম লতিফুল কবির ছিলেন লুটপাটের প্রধান কারিগর। তিনি পলকের ফাইন্যান্সার হিসেবেও পরিচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন ডাটা সেন্টার প্রকল্পে সিস্টেম এনালিস্ট পদে দায়িত্ব পালনের সময় লতিফুল কবির প্রতিমন্ত্রীর নজর কাড়েন। সেই থেকে দ্রুতই ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারের কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রকল্পের যাবতীয় অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে কবিরের নাম। প্রকল্পের সকল ঠিকাদার, সাপ্লায়ার, সাব-কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে নিয়ম করে টাকা আদায় করতেন তিনি। সামান্য সিস্টেম এনালিস্ট পদে থাকা অবস্থায় ঢাকার অভিজাত এলাকায় একাধিক নিজস্ব ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান তিনি। বর্তমানে তিনি মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের অবৈধ আয়ের একটা অংশ প্রতিমন্ত্রী পলকের কাছে চলে যেত। ফলে তার সকল অপকর্ম আড়াল হয়ে যেত। প্রকল্প সমাপ্তির পরে ডাটা সেন্টার কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক জেনারেশন সিস্টেম পদে পদায়ন করা হয়। এর পর থেকে তার দুর্নীতির নতুন মাত্রা যোগ হয়। কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ সকল ভেন্ডর ও সাপ্লায়ার নিয়োগের ক্ষেত্রে তার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল বলে জানা যায়।

এ ছাড়াও কোম্পানির বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির (এএমসি) আওতায় নিযুক্ত র্যা নপাওয়ার-কাইজেন-রেনিডেন্স (জেভি) কোম্পানির সাথেও রয়েছে কবিরের যোগসাযশ। র্যা নপাওয়ার কোম্পানিটির মূল কর্তাব্যক্তিরাই বলেছেন যে, তাদের কোম্পানির কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কবিরের হস্তক্ষেপ ছিল। উল্লেখ্য, উক্ত র্যা নপাওয়ার কোম্পানি ডাটা সেন্টারের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির সকল শর্তাবলি লঙ্ঘন করে তাদের বিল আদায় করে যাচ্ছে। এ যেন এক স্বেচ্ছাচারী প্রতি যা লতিফুল কবিরের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভব হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন কোম্পানির মালিক মূলত দু’জন। একজন হচ্ছেন জুয়েল আহমেদ শাকিল, যিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা এবং অপরজন মো: ইমরান ছিলেন যুবলীগের নেতা এবং লতিফুল কবিরের রাজনৈতিক বড় ভাই। লতিফুল কবির আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্যও ছিলেন বলে জানা যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপরীতে অবস্থান ছিল তাদের।

কোম্পানির সকল ক্ষেত্রে কবিরের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। বিডিসিসিএলের নিয়োগ কমিটির সদস্য হওয়ায় এসব নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের রেফারেন্স দিয়ে পদ ভেদে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

এই অবৈধ আয়ের উৎস থেকে গত নির্বাচনে পলকের ইনভেস্টর হিসেবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন বলে জানা যায়।
এ কে এম লতিফুল কবিরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে গত ২২ আগস্ট তাকে নিজ পদ থেকে দায়িত্ব পালনে বিরত থাকতে বলা হয়। আইসিটি ডিভিশনের উপ-সচিব জিল্লুর রহমানের স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে ওই নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

এ দিকে জুনাইদ আহমেদ পলকের সুবিধা ভোগীদের আরেকজন হচ্ছেন ইরেশ সারোয়ার। তিনিও ফোর টায়ার জাতীয় ডাটা সেন্টার প্রকল্পে সিস্টেম এনালিস্ট পদে থাকা অবস্থায় লতিফুল কবিরের সকল অপকর্মের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। দু’জনই একই পদবিধারী হওয়ায় যৌথভাবে পলকের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। অবৈধ ভাবে নিয়োগ পাওয়া এই ইরেশ সারোয়ারের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, ব্যবস্থাপক ইরেশ সারোয়ার একাধিক দেশের (বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া) পাসপোর্ট সংরক্ষণ করছেন অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন, যা ডাটা সেন্টারের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

এমনকি অস্ট্রেলিয়াতে ইরেশ সারোয়ারের নিজ নামে লাইসেন্সকৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানা যায়। এটি বিডিসিসিএলের নিয়োগ বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিমন্ত্রী পলক গ্রেফতার হলেও এখনো ধরা পড়েনি তার সুবিধা ভোগীদের একটি বিশাল অংশ। এদের মধ্যে ইরেশ সারোয়ার অন্যতম। তিনি বিডিসিসিএলের বোর্ড মেম্বার রকিব আহমদের ঘনিষ্ঠজন, যিনি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে বিডিসিসিএলে বোর্ড মেম্বার হিসেবে আছেন। তিনি তথাকথিত কেজেএস এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড পরিচালক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

সূত্র জানায়, এই রকিব আহমদ পলকের পক্ষে ডাটা সেন্টারের সকল আর্থিক অনিয়মের মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাজ করতেন। অর্থাৎ ইরেশ সারোয়ার এই রকিব আহমদকে দিয়েই তার আর্থিক স্বার্থ আদায় করে থাকেন। কোনো প্রকার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নিয়ে শুধু পলকের নির্দেশে এই রকিব আহমদকে বোর্ড ডিরেক্টর করা হয়।

হাসিনা সরকারের পতন এবং প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের গ্রেফতারের পরে তথাকথিত বোর্ড মেম্বার রকিব আহমদ পলাতক আছেন বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক ইরেশ সরোয়ার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা এবং বানোয়াট। আমার বিরুদ্ধে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন; কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। আসলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিচয়ও পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা আসলে দুর্ভাগ্যজনক বলে তিনি দাবি করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের বোর্ড পরিচালক রাকিব আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পলক সাহেব যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তবে তার দায়-দায়িত্ব আমার না। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এখানে একজন বোর্ড পরিচালক হিসেবে কাজ করছি। আসলে বোর্ড মিটিং ছাড়া কোম্পানিতে তেমন একটা যাওয়া হয় না।

১৯৯৬ সাল থেকে এ খাতে কাজ করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় এ খাতে কাজ করার ফলে অনেকের সাথে তার চেনাজানা। এতে যে কেউ অনেকের সাথে জড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। কারণ কাজ করতে গেলে যেমন বন্ধু হয়, তেমন শত্রুও তৈরি হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে তারা বিরোধী পক্ষ বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের কোম্পানি সচিব এ কে এম লতিফুল কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে তার অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলেন। এই মুহূর্তে কথা বলতে পারবেন না বলে তিনি জানান।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/863010