১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার, ৪:১১

স্থবির প্রকল্পে খরচ বাড়ছে ৯১ শতাংশ

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেয়া বেশির ভাগ প্রকল্প যেন ঝিমুনি রোগে আক্রান্ত। লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মূল প্রকল্পের এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনকার্যক্রম স্থবির অবস্থায় রয়েছে। দুই বছরের এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। দুই বছরে খরচের অগ্রগতি মাত্র ০.০১ শতাংশ। এখন প্রায় বন্ধ থাকা এই প্রকল্পের খরচ ৩৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা থেকে ৯১ শতাংশ বাড়িয়ে ৭২৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা করা হচ্ছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো সোয়া দুই বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে বলে প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে। বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের নেটওয়ার্ক ডিজাইন চূড়ান্তকরণে রাশান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফি পরিশোধে আরোপিত শর্তগুলো পরিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ক্রয় সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া সম্পাদন সত্ত্বেও রাশিয়ার পরামর্শক ফার্মের সাথে চুক্তি করতে না পারায় দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায় বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান। তারা বলেন, এখন নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দেয়া সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অত্যাধুনিক ও উচ্চগতিসম্পন্ন এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ২০২২ সালের মার্চে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এর আওতায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এক্সটার্নাল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে মোট ৩৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়। বাস্তবায়নের জন্য সময় ধরা হয় এপ্রিল ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত। পুরো মেয়াদে অর্থাৎ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে মাত্র চার কোটি ৮২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ফলে আর্থিক ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রে অগ্রগতি ০.০১ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর এর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১৮৪ কোটি দুই লাখ টাকা বরাদ্দসহ এটি চলমান প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এখন এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ ৯১.০৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭২৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। আর বাস্তবায়নের মেয়াদও আরো সোয়া দুই বছর বা ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বলছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিটিসিএল বলছে, প্রকল্পের নেটওয়ার্ক ডিজাইন চূড়ান্তকরণে রাশান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক ফি পরিশোধে আরোপিত শর্তগুলো পরিপালন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। ফলে ক্রয় সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া সম্পাদন সত্ত্বেও চুক্তি করতে না পারায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। তিনটি এনটিটিএন অপারেটরস থেকে আইআরইউ ভিত্তিতে অপটিক্যাল ফাইবার লিজ নেয়া বাবদ চাহিদাকৃত বাস্তব ব্যয় অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনাতে বর্ণিত প্রাক্কলিত ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। চাহিদা, কারিগরি ও সেবাজনিত কারণে টেলিকম সরঞ্জামাদি ও সিকিউরিটি ইকুইপমেন্টের বিভিন্নতায় ও সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। এনপিপির জন্য সিকিউরিটি বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে সব লেয়ারে নতুন করে সিকিউরিটি যন্ত্রপাতি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল ডিপিপিতে ছিল না। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) রেহানা পারভীনের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মূল্যায়ন কমিটির সভায় প্রস্তাবিত খরচের অঙ্ক নিয়ে আপত্তি তুলে তা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা আর অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ খাতে আট লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু দুটো মিলে কমিয়ে দুই কোটি টাকা করার সুপারিশ করেছে সভা। আর আট বছরে দুই ধরনের ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ২৪১ কাটি পাঁচ লাখ টাকা। এখানে একটিতে ব্যয় ৪৮ লাখ টাকা এবং আরেকটিতে ১৯৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এখানে এই ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ভ্যাটসহ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩১ কোটি ২২ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমানের সাথে গতকাল মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, পিইসি সভার সুপারিশের আলোকে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখানে আগের প্রস্তাবনা থেকে ব্যয় অনেক কমেছে। এখন ব্যয় ৫২৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। অনুমোদন দ্রুত হলে আশা করছি আগামী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত যে সময় দেয়া হয়েছে তাতে করার চেষ্টা করব।

প্রকল্পটির কোনো অগ্রগতি নেই কেন জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জানান, আসলে কাজ কোনেটাই হয়নি। কারণ আমাদের বিদেশী পরামর্শক রাশিয়া থেকে নিয়োগ করার কথা ছিল। তারা চূড়ান্ত করবে নকশাটা কী হবে। তবে একটা ডিজাইনের আলোকে আমাদের দরপত্র হয়েছিল। আমাদের স্থানীয় যারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল, তাদের মাধ্যমে করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, এ ধরনের কাজে বাংলাদেশের কারো অভিজ্ঞতা নেই। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশের জন্য নতুন। যার কারণে এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের কারো নেই। যার কারণে রাশিয়ান কনসালটিং ফার্মের মাধ্যমে ভেটিং করার কথা ছিল। আমাদের দূতাবাসসহ সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা পরামর্শক ফার্ম নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে পেমেন্ট ইস্যু নিয়ে রাশিয়ার সাথে আমাদের সমস্যা হয়। তাদের শর্তানুযায়ী পেমেন্ট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ওনাদের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পেমেন্ট করার সুযোগ নেই। যার কারণে তাদের সাথে আমরা চুক্তি করতে পারিনি। তিনি বলেন, এখন আমাদের করণীয় কী। আগের মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে মিটিংয়ে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটি একটা ডিজাইন চূড়ান্ত করেন। সেটার আলোকে এখন আমরা কাজ করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/862653