৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৩৯

আমি কি আর খেলতে পারব?

খুব কাছ থেকে করা পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত কিশোর সাইফুল ইসলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে মায়ের কাছে জানতে চাইছিল, ‘মা, আমি কি আগের মতো বন্ধুদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে পারব না, আমি কি আর কখনো দৌড়াতে পারব না?’ মা আয়েশা বেগম ছেলের পাশে বসে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তুমি আবার খেলতে পারবে, আবার দৌড়াতে পারবে। তুমি শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে, একটু ধৈর্য্য ধরো বাপ।’ এ প্রতিবেদককে মা আয়েশা বলেন, ‘ছেলেকে এসব বলে সান্ত্বনা দেই, কিন্তু আমি নিজেও জানি না আমার ছেলে আগের মতো দৌড়াতে পারবে কি না। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার ছেলের। সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না’ বলছিলেন আর চোখের পানি মুছছিলেন তিনি। আয়েশা বেগম ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘যদি ধরেও নিই যে, আমার শিশুপুত্রটি মিছিলে গিয়ে দোষ করেছে, তাই বলে এভাবে মারতে হবে? পুলিশ কি শুধুই পুলিশ, এদের কারো কি পুত্র-কন্যা নাই? এরা কি এতই পাষাণ? এই শিশু ছেলেটিকে এত কাছ থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করার প্রয়োজন পড়ল কেন ? পুলিশ কি এ দেশের খেয়ে-পরে বড় হয়নি, না কি এরা বিদেশী?’ কথা বলার সুযোগ পেয়ে এ ধরনের অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন এ প্রতিবেদকের প্রতি।
খানিক পরেই একটু স্বাভাবিক হয়ে আয়েশা বেগম কিছুটা সময় নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্যরি, সাংবাদিক ভাই, আমার ছেলের ব্যাপারে অনেক দিন আপনার মতো দরদ দিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। তাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম।’ তিনি জানান, তাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলায়। সাইফুল স্থানীয় নিশ্চিন্তপুর আব্দুল গফুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। রাজধানীর বাড্ডায় তার বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল সে। স্কুল বন্ধ থাকলে প্রায়ই বোনের বাসায় বেড়াতে আসে সাইফুল ইসলাম। সে কারণে এখানে তার কিছু বন্ধুও হয়ে গেছে। ৪ আগস্ট, শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। চারদিক ছিল খুবই উত্তপ্ত। শেখ হাসিনার দেয়া পাঠ্যপুস্তক অন্যদের মতো সাইফুলেরও ভালো লাগেনি। সেই থেকে ক্ষোভ ছিল ছোট সাইফুলের মনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাড্ডা এলাকার বড়-ছোট সবাই সুযোগ পেলেই মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। বড়দের স্লোগান মুখস্থ করে ছোটরাও রাস্তায় নেমে যেত। পুলিশ দেখলেই দৌড়ে লুকিয়ে পড়ত।

৪ আগস্ট দুপুরের দিকে সাইফুলও বাড্ডায় বোনের বাসার আশপাশের বন্ধুদের সাথে মিছিলে বেরিয়েছিল। কিছু দূর যেতে না যেতেই পুলিশের গাড়ি সামনে চলে আসে। সাইফুলরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে মিছিলের ওপর গুলি করতে শুরু করে। পুলিশের গুলির মুখে সবাই যখন পালাচ্ছিল তখন সাইফুল কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। দৌড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই পুলিশ তার হাঁটুর নিচে গুলি করে। গুলি লাগলেও প্রথমে বুঝতে পারেনি, ওই অবস্থায়ই বাসার দিকে দৌড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি, রাস্তায় পড়ে যায়। এরপর কী হয়েছে, কিশোর সাইফুলের আর কিছু মনে নেই। ওর মা আয়েশা বেগম বলেন, আমার মেয়ের কাছ থেকে শুনেছি, সাইফুল তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। গুলি হাঁটুর নিচে মাংসের ভেতরে ঢুকে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। রাস্তা ভেসে গিয়েছিল রক্তে। কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়েছিল সে। সাইফুলের বন্ধুরা তার বোনের কাছে ওর গুলিতে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকার বিষয়টি জানায়। বোন লোকজনের সহায়তায় তাকে বাসায় নিয়ে এসে রক্ত থামানোর চেষ্টা করে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বনানীর একটি হাসপাতালে সাইফুলকে ভর্তি করা হয়।

আয়েশা বেগম জানান, সেই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে ৭০ হাজার টাকা খরচ হলেও সাইফুলের কোনো উন্নতি হয়নি বরং ইনফেকশন হয়ে যায়। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত হয়েছে সরকার তাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে শুনে ওকে গত ২৯ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে চিকিৎসা চলছে, ওষুধ ও অন্যান্য সেবা বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের ৫ম তলায় মঙ্গলবার বিকেলে কথা হচ্ছিল সাইফুল ও তার মা আয়েশা বেগমের সাথে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাইফুলের পুরোপুরি সুস্থ হতে কমপক্ষে দু’বছর লেগে যাবে। গুলি হাঁটুর নিচের হাড়কে তিন টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়েছে। সাইফুল বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে বিকালটা কাটাত। এখন সে বারবার বলছিল, আবার কবে খেলতে পারবে? আবার কি দৌড়াতে পারবে? আয়েশা বেগম ছেলেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নানা কিছু বললেও কবে যে ছেলে সুস্থ হবে তা ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞাসা করেও সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস পাননি। তবে ডাক্তাররা বলেছেন, দুই বছরের আগে সে দৌড়াতে পারবে না। ওদিকে স্কুলে যাওয়া ও খেলাধুলা করার জন্য সাইফুলের মন অস্থির হয়ে আছে। সাইফুল কি আগের মতো সত্যিই দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে? আয়েশা বেগমের মনে সন্দেহ রয়েই যায়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/861458