৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৯:৩১

তীব্র পানি সংকটে কুষ্টিয়ায় ফসল ও খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

কুষ্টিয়ায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় কৃষি জমি ফেটে চৌচির। পুড়ে যাচ্ছে মঠের পর মাঠের ফসল। অনাবাদি পড়ে আছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। জেলাজুড়ে কৃষকদের মধ্যে চলছে পানির জন্য হাহাকার। তীব্র তাপদাহে ঝরে যাচ্ছে আম ও লিচুর গুটি, ধানে হচ্ছে চিটা, পাটগাছ নেতিয়ে পড়ছে, বিভিন্ন সবজীর ফলন কমে গেছে, কলা গাছে সেচ দিতে না পারায় মারা যাচ্ছে। পানি সংকটের সমাধান না হলে আগামী আউশ মৌসুমে ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বিভিন্ন ফসল ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশংকাা করছে কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি অফিসের সূত্র মতে, চলতি মওসুমে জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৮শত ৩০ হেক্টর। কিন্তু পানি সংকটের কারণে আবাদ হয়নি ৬ হাজার হেক্টরা জমি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মিরপুর ও কুমারখালী উপজেলায়। সেখানে বোরো মৌসুমে অনাবাদি ৫ হাজার ৩শত ২ হেক্টর জমি। এছাড়া কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ১ হাজার ১২৫ ও কুমারখালী উপজেলায় ৭৬৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়নি।

এদিকে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫শত হেক্টর জমিতে। ফলে পানি সংকটের কারণে আউশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে জেলার তিন উপজেলায় কয়েক হাজার বিঘা আউশের জমি ফাঁকা পড়ে আছে।
সদর উপজেলার জগতি এলাকার কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ১২বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান ও ভুট্টা লাগিয়েছি। জমি চাষাবাদ ও সেচে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আর টাকা দিলেও পানি যাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র তাপদাহে ভুট্টার গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। ধানের শীষ আসা অবস্থায় গাছ নুয়ে পড়ছে। কিছু গাছে শীষ বের হলে সব চিটা হয়ে যাচ্ছে। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে নিঃস্ব হয়ে যাব বলেও তিনি জানান।

একদিকে জিকে ক্যানালে পানি নেই, অন্যদিকে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামছে। স্যালোতে উঠছেনা প্রয়োজনীয় পানি। মাঠের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে অধিকাংশ পাম্প। দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে বন্ধ রয়েছে জিকে প্রকল্পের তিনটি পাম্পই। একারণে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে জিকে ক্যানেল।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ী এলাকার কৃষক ইজাবুল হক বলেন, জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছি। দুই বিঘা জমিতে সবজি ও কলা গাছ রয়েছে। জমির পাশে জিকে ক্যানাল থাকলেও পানি নেই। জমির সঙ্গে বোরিং বসিয়েও কাজ হচ্ছেনা। পানির অভাবে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েক দিন গেলে সব শুকিয়ে যাবে।

কুমারখালী উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ ধানসহ সব ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে। বিঘার পর বিঘা ভুট্টা খেত শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে শত শত বিঘার ঢ্যাঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙে, লাল শাক, ডাটা শাকসহ সব সবজি নুয়ে পড়েছে। এসব ফসলে পানি দিতে না পেরে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার। তারা বলছে, টাকা দিয়েও মিলছেনা পানি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফসল ফলিয়ে তা ঘরে তুলতে পারছেন না। এমন সংকটের তারা আগে কখনো পড়েননি। এদিকে পদ্মা ও গড়াই নদীতে তলায় সামান্য পানি রয়েছে। সেতুর পিলারগুলো চওে আটকে গেছে। ফারাক্কার বিরুপ প্রভাবে মরুকরনের দিকে এগুচ্ছে সারা জেলা।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে মাঠে সবজিসহ ধান, পাট, ভুট্টা, কলা, আখসহ বিভিন্ন ফসল রয়েছে। তীব্র তাপদাহে এসব ফসল জমিতেই পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল বলেন, পানি সংকটের কারণে বোরো আবাদ ব্যাহত হয়েছে। আউশ উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি না হওয়া এবং তীব্র তাপদাহে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এ বছর পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়া অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত সোমবার জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। উত্তপ্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়া অঞ্চল। শহরেও পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

শহরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা মাহবুব রহমান বলেন, অনেক মানুষে নিজের পয়সায় সাবমারসিবল বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। একটা সাবমারসিবল বসাতে অর্ধ লাখ টাকা খরচ হয়। আমরা পারিনা। পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে।

মিরপুর উপজেলার ধুবইল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সামাদ বলেন, এলাকার মানুষের বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে খাওয়ার পানি। পানির অভাবে এলাকাবাসী গরু-ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও এক বালতি পানি তোলা যাচ্ছেনা। এখন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। মোল্লাতেঘরিয়ার নাসির উদ্দীন বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে ১৭০ ফুট পাইপ বসিয়েছি। এরপরও পানি উঠছেনা। মোটর বসানো আছে, সেখানেও পানি উঠছেনা।

কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, জিকে সেচ প্রকল্প বন্ধ এবং আবহাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত। কয়েক সপ্তাহ ধরে খরা চলছে। শুধু পৌর এলাকায় নয়, গ্রামাঞ্চলেও পানির সংকট চলছে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই এ সময় পানির স্তর নেমে যায়। বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে প্রতিবছর এক/দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এবার সময়টা বেশি লাগছে। চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। জিকের সব পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে পড়েছেন কৃষকেরা। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে নিশ্চিত নয়।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে তিনটি পাম্প বন্ধ রয়েছে। পাম্পগুলো সচল করার চেষ্টা চলছে। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি রফিকুজ্জামান বলেন, পানি সংকটের কারণে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টি হলেই সংকট কেটে যাবে।

এদিকে জেলাজুড়ে প্রতিদিন বৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্থানে ইসতেস্কার নামাজ আদায় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি পিপাসিত জনগণের মাঝে খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ করে চলেছে।

https://www.dailysangram.info/post/554904