২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:২৮

সরজমিন

ঠাঁই নেই শিশু হাসপাতালে

এগারো মাসের শিশু রিফা ইসলাম রামিসা। ৭ দিন ধরে জ্বর। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। মঙ্গলবার রাতে বাবা-মা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে শয্যা না থাকায় ফিরে আসতে হয়। বুধবার সকালে ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ফের তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েকে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা রামিসার মা ফাতেমা বেগম মানবজমিনকে বলেন, পরীক্ষা করিয়ে মেয়ের নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। পরে মেয়েকে স্থানীয় এক চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি কোনো জায়গা নেই। আজ ভর্তির জন্য শিশু হাসপাতালে আসি। সকাল থেকে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করছি এখন বেলা দুইটা বাজে তাও ভর্তি করাতে পারিনি।

আরও কিছুক্ষণ এখানে অপেক্ষা করে অন্য হাসপাতালে চেষ্টা করতে হবে।
শুধু রামিসা নয়, তীব্র গরমে প্রতিদিন জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক শিশু। প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১৪০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে এই হাসপাতালে। দিন দিন বাড়ছে রোগীর চাপ। দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে সরজমিন দেখা যায়, টিকিটের জন্য অপেক্ষায় রোগীর অনেক স্বজন। টিকিট কাউন্টারের সামনে ভিড়। বহিঃবিভাগ ও জরুরি বিভাগের সামনে ভিড়। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, সবগুলো ওয়ার্ডই রোগীতে পূর্ণ।

সূত্র জানায়, ৬৮১টি শয্যার একটিও খালি থাকে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৯৫ জন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বহিঃবিভাগে ২৭৫ উপরে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশিজনিত আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ১৬ জন। ডায়রিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে ৬৮ জন। এরমধ্যে ভর্তি হয়েছে ৩ জন। স্কিন ডিজিজগুলোতে চিকিৎসা পেয়েছে ৯৫ জন। প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১৪০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বহিঃবিভাগ ও জরুরি বিভাগসহ মোট রোগী দেখা হয়েছে ১ হাজার ২০০’র মতো। এরমধ্যে বহিঃবিভাগে এসেছে ৯০০ এবং জরুরি বিভাগে ৩০০ জন।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৭ দিন ধরে শিশু হাসপাতালে ভর্তি ৭ মাস বয়সি আয়েশা। তার মা সীমা বেগম বলেন, প্রথমে মেয়ের কাশি হয়। শরীরে কোনো জ্বর ছিল না। হাসপাতালে আসার পর জ্বর আসে। কাশি, জ্বর একটু কমের দিকে গেলেও গতকাল থেকে আবার ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা যাচ্ছে। আজও চারটি টেস্ট দিয়েছে। এর আগে এই ইউনিটের অন্য বেডে ছিলাম সেখানে অনেক টাকা খরচ হয়। এজন্য সরকারি বেডে এসেছি। এখানে একটু কম টাকা খরচ হচ্ছে।

৩ বছরের শিশু মঞ্জিলের মা বীথি বলেন, মেয়ের জ্বর আসার পর পরীক্ষা করিয়ে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। এখানে ১৫ দিন ধরে ভর্তি। গ্রামের বাড়ি ভোলা। এলাকার স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করলে ঢাকাতে রেফার করে। গরমের কারণে মেয়ে ঘেমে জ্বর আসছে। এখন তো আরও গরম। এতে ঠাণ্ডা-কাশি আরও বাড়ছে। অনেক খরচ হচ্ছে। এই ১৫ দিনে সবকিছু মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। ওর ছোটবেলা থেকে শ্বাসকষ্ট ছিল।

আড়াই বছরের শিশু সাঈফা। সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নিউমোনিয়া ইউনিটের ১০ নম্বর বেডে ভর্তি। তার স্বজনরা বলেন, সাঈফার ঠাণ্ডা, কাশি, নিউমোনিয়া হয়েছে। তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। জ্বর, কাশি হওয়ার পর মিরপুরে দেখানো হয়। সেখান থেকে জ্বর না কমায় শিশু হাসপাতালে আনা হয়। এরপর ভর্তি করা হয়। এখন কিছুটা সুস্থতার দিকে।

শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ফারহানা আহমেদ স্মরণী মানবজমিনকে বলেন, তীব্র গরমে শিশু হাসপাতালের প্রতিদিন বেড়েই চলছে রোগীর চাপ। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা কাশি, জ্বর, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। রোগীর চাপ বাড়ার কারণে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকটও। বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ জন্ডিস, আমাশা, রক্ত আমাশয়, বিভিন্ন স্কিন ডিজিজ এই রোগীগুলো আমরা পাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি পাচ্ছি ঠাণ্ডা, কাশি, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এখন ঘরে ঘরে ছোট-বড় সবাই জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাচ্চাদের সেখান থেকে জটিল আকার ধারণ করে নিউমোনিয়ায় চলে যাচ্ছে। আমাদের এখানে সারা দেশ থেকে রোগী আসে। আইসিইউতেও বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী রেফার করা হয়। চাপ সামলানোর জন্য আমরা যেটা করছি যেসব বাচ্চাগুলোকে যথাসম্ভব বাসায় চিকিৎসা দেয়া যায় তাদের চিকিৎসার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে রোগীর অবস্থা বুঝে আবার কখন হাসপাতালে নিয়ে আসবে সেটি পরামর্শ দিয়ে দিচ্ছি। যেহেতু হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি প্লাস ভর্তি করা সম্ভব না। আর যাদের জটিলতর সমস্যা দেখছি তাদেরই আমরা শুধুমাত্র ভর্তি করছি। প্রতিদিন ১৫০ রোগী ভর্তি করা হলে সেই পরিমাণ রোগীকে তো ছুটি দিতে হবে। যারা একটু সুস্থ ফিল করছে বাকিটুকু চিকিৎসা বাসায় নিতে পারবে তাদেরকে আমরা দ্রুতই ছুটি দিয়ে দিচ্ছি। চাপটা সামলানোর জন্য এটা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই তাপপ্রবাহে শিশুদের ক্ষেত্রে চারটি নিয়ম মানতেই হবে। বাচ্চা কি খাবে, কি পরবে, তারা কোথায় থাকবে, অসুস্থ ফিল হলে কখন বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে এটি বাবা-মায়ের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। একটু পর পর বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে। বিভিন্ন তরল খাবার, মৌসুমি ফলের রস, ডাবের পানি, জুস, সুপ, লেবুর শরবত ইত্যাদি খেতে দিতে হবে। এই অতিরিক্ত গরমে হালকা কালারের নরম পোশাক পরতে হবে। একদম ঠাণ্ডা পানি না খেয়ে মিক্সড করে খেতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শিশুদের ঘরের বাইরে বের না করা ভালো।

https://mzamin.com/news.php?news=107021