২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৮:০৬

সরজমিন ঢাকা মেডিকেল

শিশু রোগীতে গিজগিজ

দেশ জুড়ে তীব্র দাবদাহ। দিনে যেমন প্রখর রোদ, রাতেও তাপমাত্রার পারদ নামছে না। সব মিলিয়ে বৈশাখের তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। তীব্র গরমে সর্দি, কাশি জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হচ্ছে শিশুরা। বাড়তি রোগী আসায় ঢাকা মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে ঠাঁই নেই অবস্থা। গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলার শিশু বিভাগের ২০৭, ২০৮ ও ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। একটি বেড একজনের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২ থেকে ৩ জন রোগী। ওয়ার্ডের মেঝেতেও তিল ধারনের জায়গা নেই। মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।

আর ওয়ার্ডের মেঝেতেও যাদের জায়গা হচ্ছে না তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন বাইরের বারান্দায়। জুঁই আক্তার ১০ মাসের মেয়েকে নিয়ে গত দুদিন আগে এসেছেন ঢাকা মেডিকেলে। তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরমে আমার মেয়ের ডায়রিয়া হয়েছে। প্রথমে হাসপাতালে ভর্তিই নিতে চায়নি। অনেক কষ্ট করে ভর্তি করিয়েছি। এখানে এসে দেখি মেঝেতেও জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বারান্দায় স্যালাইন দিচ্ছি। শিউলি আক্তার তার মেয়ে সাজেদাকে নিয়ে আছেন ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেঝেতে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার মেয়ের পেটে সমস্যা। পেটে ব্যথা, জ্বর। কিছুদিন বাসায় রেখে প্যারাসিটামল ও স্যালাইন খাইয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। তাই এখানে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে দেখি আমার মেয়ের মতো অনেকেই এখানে ভর্তি। একেক বেডে দুইজন-তিনজন করে রোগী। কোনো রকম চেষ্টা করে মেঝেতে একটু জায়গা পেয়েছি। স্বপ্না বেগমও তার ২ মাসের শিশুর চিকিৎসার জন্য এসেছেন ঢামেকের শিশু ওয়ার্ডে। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, তাকে এনআইসিইউতে রাখা লাগবে। এখানে এনআইসিইউতে কোনো সিট খালি নেই। পরে মেয়ের জন্য এনআইসিইউ’র খোঁজে বাইরে বের হন তার স্বজনরা।

২০৮ নম্বর ওয়ার্ডেরও একই অবস্থা। সেখানে চিকিৎসা নেয়া এক শিশুর মা সুমাইয়া আক্তার বলেন, আমার ছেলের গত তিন-চার দিন ধরে জ্বর, কাশি। গত শনিবার রাত থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়। রাতভর স্যালাইন খাইয়ে কাজ না হওয়ায় রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে নিয়ে আসি। সেখান থেকে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, এই গরমেই ফ্যানের নিচে শুইয়ে রাখলেও বাচ্চার গলা, মাথা, পিঠ ঘেমে ভিজে যায়। আর ওই ঘাম থেকেই ঠাণ্ডা লেগে জ্বর চলে আসে। এরপর পেটেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমার এত চঞ্চল ছেলেটা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। এক বেডে একাধিক রোগীর বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে সকলেই বিপদে পড়ে এসেছেন। সকলেই তার বাচ্চাকে ভালোবাসেন। তাই যেখানে যেমন জায়গা পাচ্ছেন সেখানেই রেখে চিকিৎসা করাচ্ছেন। এদিকে ২১০ নম্বর ওয়ার্ডেও জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর চাপ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়াতে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীদেরকে পাঠানো হচ্ছে গাইনি ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন জায়গায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের শিশু বিভাগেরে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সায়মা বলেন, এই তীব্র গরমে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে রোগীর সংখ্যা। এদের মধ্যে ডায়রিয়া, জ্বর, কাশি, পানিশূন্যতার প্রবণতা বেশি। শুধুমাত্র যাদের অবস্থা গুরত্বর তাদেরকেই ভর্তি করা হচ্ছে। বেশিরভাগ রোগীকেই সাধারণ চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপরও আমাদের একেক বেডে দুই-তিনজন করে রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। নির্ধারিত বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। পর্যাপ্ত এনআইসিউ ও পিআইসিইউ না থাকার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, সাধারণত আমাদের হাসপাতালে শিশুদের জন্য আলাদা কোনো আইসিইউ এর কোনো ব্যবস্থা নেই। শিশুদের শূন্য থেকে ২৮ দিনের বাচ্চাদের জন্য এনআইসিইউতে বেড আছে একশ’র মতো। আর পিআইসিইউতে বেড আছে ১০ থেকে ১২টা। সেখানে সকলের সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক শাহেদুর রহমান বলেন, এই সময়ে বহির্বিভাগের আসা রোগীর বেশির ভাগই সর্দি-জ্বর নিয়ে আসছেন। খুব জটিল না হলে ভর্তি রাখা হচ্ছে না। তিনি বলেন, এবারের জ্বর ১০৩ থেকে ১০৫ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। মুখে খাওয়ার প্যারাসিটামলেও অনেক সময় জ্বর নামছে না বা নামলেও আবার একই মাত্রার জ্বর উঠছে। আইইডিসিআরের কাছে নমুনা পাঠানো হয়েছে ধরন বোঝার জন্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, সাধারণত বছরের এই সময়ে গরমে রোগীর চাপ অন্য সময়ের চেয়ে একটু বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাইখ আবদুল্লাহ জানান, ঈদের পর এই তীব্র গরমে রোগীর চাপ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ কিছু বিষয় তিনি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। ঘাম শুকিয়ে যায়, এমন সুতির জামা পরিয়ে রাখতে হবে। বাইরে থেকে আসার পর ঘাম মুছে দিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া যাবে না।

https://mzamin.com/news.php?news=106739