৬ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:৪৬

বান্দরবানে যৌথ অভিযান শুরু

ব্যাংক অস্ত্র লুট ও ম্যানেজার অপহরণের ঘটনায় ৪টি মামলা

নতুন করে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। যাদের সন্ত্রাস আর লুটপাটের কারণে আতঙ্কে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। বান্দরবানে সশস্ত্র হামলা ও ব্যাংক লুটপাটের পর বর্তমানে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পাহাড়ের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী এই কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে গতকাল শুক্রবার থেকে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ এই অভিযান কেএনএফ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত চলবে বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এদিকে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকের টাকা ও অস্ত্র লুট এবং ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়েছে। রুমায় তিনটি ও থানচিতে একটি মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টায় বান্দরবান জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে র‌্যাব। সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, সন্ত্রাসীদের দমনে পাহাড়ে জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হবে। বান্দরবানের রুমা-থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও হামলার ঘটনাটি মূলত টাকা লুট ও কেএনএফ এর সক্ষমতা জানান দিতেই হয়েছে বলে মনে করছেন র‌্যাব। সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুইটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, সক্ষমতা প্রদর্শন করা। কেএনএফ তাদের সমর্থক ও প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দেখাতে চাইছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই লক্ষ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করছিল। কিন্তু সেই সুযোগে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট, পুলিশ ক্যাম্পে গুলীবর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়েছে। সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিন উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, রুমা ও থানচি উপজেলায় গত সোম ও মঙ্গলবার ব্যাংক ডাকাতি ও লুটপাট হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। তাকে নিরাপদে উদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধীদের শনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজ ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মিলিত সাঁড়াশি অভিযানে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। লুট করে নেওয়া ১৪টি অস্ত্র উদ্ধারসহ তাদের নির্মূল করা হবে।

এদিকে রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর শুক্রবার সন্ধ্যায় ছাড়া পেয়েছেন। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় তৎপরতা শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে সমতলের জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া জঙ্গিগোষ্ঠীকে পাহাড়ের গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ আছে বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বছরের অক্টোবরে কেএনএফ ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা করে। পরে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ২৯ মে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও গত ৫ মার্চ দুই দফা কমিটির বৈঠকে কেএনএফ সন্ত্রাসী কর্মকা- না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। গতকাল শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. শরীফ মাহমুদ অপু জানান, শনিবার (আজ) ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে বান্দরবানে যাবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বান্দরবানের রুমাসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দুপুরে বান্দরবান সার্কিট হাউসে মতবিনিময় শেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তিনি। ঢাকা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাবেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

হামলা ও অপহরণ যেভাবে: বান্দরবানে সোনালী ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধারের আদ্যোপান্ত জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গত মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে শতাধিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কুকি-চীন সদস্যরা তাদের নিজস্ব পোশাক পরে বান্দরবানের রুমা সোনালী ব্যাংকের উত্তর দিক (বেথেল পাড়া) থেকে পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগে অতর্কিত হামলা চালিয়ে মারধর করে অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্য লোকদের জিম্মি করে ফেলে। এ সময় সোনালী ব্যাংকের ডিউটিরত গার্ড কনস্টেবলসহ সর্বমোট ১০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুটি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি, আটটি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি, আনসার সদস্যদের চারটি শটগান ও ৩৫ রাউন্ড কার্তুজ লুট করে। পরে সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করে। ভল্টে টাকা না পেয়ে পরে ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আল মঈন বলেন, ঘটনাটি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি ও জনমনে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে র‌্যাবের একাধিক আভিযানিক দল। অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও তথ্য সংগ্রহসহ র‌্যাবের আভিযানিক কার্যক্রম শুরু করে।

র‌্যাবের কাছে ম্যানেজার নেজাম উদ্দিন সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলা এবং হামলার পরে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। ম্যানেজার র‌্যাবকে জানান, মঙ্গলবার রাতে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শতাধিক সশস্ত্র কুকি-চীন সদস্য রুমা সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক এবং আশপাশের এলাকায় ভীতি সঞ্চার করে তাকে খুঁজতে থাকে। লোকের মাধ্যমে জানতে পারে পার্শ্ববর্তী মসজিদে এশার নামাজ পড়ছেন। সন্ত্রাসীরা মসজিদে প্রবেশ করে সব মুসল্লিকে জিম্মি করে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। পরে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর আগে তিনি সন্ত্রাসীদের কৃষি কর্মকর্তা পরিচয় দিলে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পরিচয় নিশ্চিত হয় কুকি চিন। এ সময় সন্ত্রাসীরা এক ধরনের সামরিক পোশাক পরা ছিল। মুখম-ল কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। ব্যাংকের চারপাশ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘিরে রেখেছিল। ম্যানেজার বলেন, সন্ত্রাসীরা জানতে চেয়েছে ঘটনার দিন ব্যাংকে কত টাকা নিয়ে আসা হয়েছে এবং ব্যাংকের ভল্টে মোট কত টাকা রক্ষিত আছে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে ম্যানেজারের কাছে ব্যাংকের ভল্টের চাবি চাইলে তখন তিনি কৌশলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারপর তারা ভল্ট ভাঙতে চেষ্টা করে। পরে ম্যানেজারের কাছ থেকে আরও জানতে পারে, ভল্টে আঘাত করলে সেন্সরের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যাপারটি সোনালী ব্যাংকের হেড অফিস জেনে যাবে। তখন তারা ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার পরপরই চোখ বেঁধে ফেলে। টানা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কোনও এক অপরিচিত পাহাড়ের ঝিরিপথে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় তার সঙ্গে ১০-১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছিল। পথে তারা চোখ খুলে দেয়। অন্ধকারে চলার সুবিধার্থে হাতে একটি বাটন ফোন ধরিয়ে দেয়। পথে তারা কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেয়। এরপর আবার হাঁটায়। রাত আনুমানিক আড়াইটায় নীরব অজ্ঞাত এক স্থানে তাকে নিয়ে গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ দেয় এবং যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তারা পাহারা দেয়। ঘটনার পরদিন সকালে সামান্য নাশতা দিয়ে আবারও হাঁটিয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে অন্য একটি পাহাড়ের ঝিরিতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় ৩০-৩৫ জনের মতো সশস্ত্র সন্ত্রাসী অবস্থান করছিল। এ সময় তারা কলার পাতায় করে গরম ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খেতে দেয়। পরে সেখান থেকে হাঁটিয়ে অন্য জায়গায় পুনরায় নিয়ে যায়। সেখানে ১৫-২০ মিনিটের মতো বিশ্রামের সুযোগ দেয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে তারা ধাপে ধাপে বিশ্রাম এবং হাঁটার পর ভিন্ন একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছালে আবারও তাকে গরম ভাত, ডাল ও ডিম খেতে দেয়। র‌্যাব জানায়, অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয় এবং কোনও প্রশাসনিক বা আইনি সহায়তা যাতে না নেয়, তার পরিবারকে সেজন্য সতর্ক করে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ওই সূত্র ধরে র‌্যাব অবস্থান শনাক্ত করে। র‌্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে বান্দরবানের রুমা বাজার ও বেথেল পাড়ার মধ্যবর্তী কোনও এক স্থান থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায় কেএনএফের সন্ত্রাসীরা। তারা স্থানীয় বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনটি বন্ধ করে দেয়। পরে স্থানীয় চা দোকানে থাকা ব্যাংক ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে ভল্টের চাবি ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু তারাবি নামাজের জন্য মসজিদে থাকা ব্যাংক ম্যানেজারের কাছ থেকে চাবির অপর গোছাটি না পেয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা।

https://www.dailysangram.info/post/553307