৮ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ৭:০৭

শুল্ক আরোপে খেজুরে দাম আকাশচুম্বী রোজাদারদের ইফতারে কষ্ট বাড়বে

পবিত্র রমযানে খেজুর দিয়ে ইফতার করা রাসূল সা. এর অন্যতম সুন্নাত এবং সওয়াবের কাজ। কিন্তু এবার খেজুর আমদানিতে অধিক পরিমাণে শুল্ক আরোপ করায় খেজুরের দাম আকাশচুম্বী গিয়ে ঠেকেছে। বাজারে মুখে দেয়ার মতো মধ্যম মানের খেঁজুরের দাম ৬০০ টাকা। আর একটু ভালে মানের খেজুর কিনতে কেজি প্রতি ব্যয় হবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। খেঁজুরের পাশাপাশি ইফতারের অন্যান্য পণ্যের দামও অস্বভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোলা, চিনি, লেবু, ডালসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়েছে যে, একজন রোজাদার কয়েকটি আইটেম দিয়ে মধ্যম মানের ইফতার করতেও কমপক্ষে ব্যয় হবে ২০০ টাকার মতো। এতে করে অল্প আয়ের রোজাদারেরা সারাদিন রোযা শেষে ইফতার করা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাজারে দেখা গেছে, মধ্যম মানের খেজুরের কেজি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। এতে করে একজন রোজাদার দিনে দুটি খেজুর দিয়ে ইফতার করলেও অন্তত ৫০ গ্রাম খেজুরের প্রয়োজন হবে। যার মূল্য ৩০ টাকার মতো। খেজুরের উপর হঠাৎ করে শুল্ক আরোপ করায় এ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। ১২০ টাকার খেজুরে ১৪০ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত শুল্ক দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। এর আগে খেজুরে সর্বোচ্চ ১০ টাকা শুল্ক দিতে হতো। খেজুরে শুল্ক প্রত্যাহার করে দাম কমানোর পরিবর্তে বড়ই দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের এক মন্ত্রী। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, একজন রোজাদার পবিত্র রমযানের ইফতারির স্বাভাবিক যেসব আইটেম দিয়ে ইফতার করে থাকেন এগুলো সবক’টির দামই বেশি। যার কারণে হিসেব করে মধ্যম মানের ইফতার করলেও জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ইফতারে ব্যয় হবে। একটি হিসেবে দেখা গেছে, দু’টি খেজুরের দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা, ১৫০ টাকা কেজি চিনি দিয়ে শুধু লেবুর শরবত তৈরি করলেও প্রতি গ্লাস শরবতের দাম পরে ২০ থেকে ৩০ টাকা, বাজারে কাঁচা ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি, আর সিদ্ধ করা ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি, রমযানে সিদ্ধ করা ছোলা ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি হবে। সে হিসেবে একজনের ইফতারে একশ গ্রাম ছোলার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা, ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি মুড়ি বিক্রি হচ্ছে । একজনের জন্য একশ গ্রাম মুড়ির দাম পড়বে ১০ থেকে ১২ টাকা। বাজারে জিলাপী বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকা। এক পিস জিলাপীর দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা। ইফতারে পেঁয়াজু, বেগুনী ও আলুর চপ, ডিম চপ এগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। বর্তমান বাজারে পেঁয়াজের কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। এক্ষেত্রে একজনের ইফতারে একটি করে পেঁয়াজু, বেগুনি ও চপ ব্যবহার করা হলেও প্রায় ৩০ টাকা ব্যয় হয়। হালিম ইফতারের জনপ্রিয় একটি আইটেম। জনপ্রতি ছোট একবাটি হালিমে খরচ হবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এছাড়াও সাধ্যমতো দু’একটি ফল খাওয়া হয়ে থাকে ইফতারে। এবার ফলের দামও আকাশচুম্বী। এক কেজি আপেলের দাম ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এক্ষেত্রে একটি আপেলের দাম পড়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এছাড়া ডালিম, আনারসহ অন্যান্য ফলের দামও প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে দেখা যায় একজনের মধ্যম মানের ইফতারের ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ব্যয় হয়। তারমধ্যে রয়েছে খেজুর ২৫-৩০ টাকা, মুড়ি ১০-১২ টাকা, ছোলা-২৫-৩০ টাকা, শরবত এক গ্লাস ২০-৩০ টাকা, জিলাপী একপিস ১৫-২০ টাকা, পেয়াঁজু-বেগুনী-চপ একপিস করে তিনপিস ৩০ টাকা, হালিম এক বাটি ৫০-৬০ টাকা, একপিস আপেল অথবা অন্য যে কোন একটি ফল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ইফতারির মুড়ি প্রসেসিং করতে তেল, পেঁয়াজ মরিচসহ আরো প্রায় ২০ থেকে ৩০ টাকা ব্যয় হয়।

এবার খেজুরের আকাশচুম্বী মূল্য রোজাদারের জন্য অন্যতম কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সারাদিন রোজা রেখে খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার শুরু করা মুসলিমদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। সারা বছর যা খেজুর বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি খেজুর বিক্রি হয় এক মাসেই। রামযানে চাহিদা বেশি থাকায় দামও কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু এ বছর আরও বেশি অস্থির খেজুরের বাজার। রমযান মাস উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে যখন কমছে খেজুরের দাম তখন দেশের বাজারে উল্টো চিত্র। অতিরিক্ত শুল্ক, আমদানি কম হওয়ায় তৈরি হয়েছে এই অস্থিরতা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর খেজুরের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। আমদানি খরচ বেশি। সরবরাহ কম। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদাও কম।

রাজধানীর পুরানা পল্টনে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বসে রাজধানীর বৃহৎ খেজুরের মার্কেট। নানা ধারনের খেজুরের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়িরা। এর মধ্যে রয়েছে, মমতাজ মরিয়ম, আজওয়া, আম্বার, মাবরুম, জাহেদি, কালমি ইত্যাদি। যা আসে সৌদি আরব ছাড়াও জর্ডান, মিশর, দুবাই, আলেজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লেবানন, পাকিস্তানসহ বেশকিছু দেশ থেকে। জাতভেদে এসব খেজুর বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দামের খেজুর দাবরাস বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকা। এছাড়াও মরিয়ম ৭০০-৮০০ টাকা, আম্বার ৮০০-১০০০ টাকা কেজি দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। যা গেল বছরে ২০০-৩০০ কমে বিক্রি হয়েছে।
পল্টনের খেজুরের দাম সর্ম্পকে জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যবসায়ী জনান, এই বছর খেজুরের দাম বেশি। গত বছর যে খেজুর বিক্রি করেছি ৬০০-৭০০ টাকা কেজি তা এবার বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকায়। তাছাড়া ঠিকমতো মাল পাওয়া যায় না। কাস্টমারও কম। এবার রমযানে কি হবে বলা যাচ্ছে না। আরেক দোকানদার বলেন, এখন পর্যন্ত ওভাবে বেচাকেনা শুরু হয় নাই। তুলনামূলক ক্রেতা কম। রমযানের অপেক্ষায় আছি।

এদিকে, আমদানিকারকরা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খেজুরকে বিলাসী পণ্য হিসেবে শুল্ক নির্ধারণ করেছে, খেজুর আমদানি করতে প্রকৃত দামের প্রায় দ্বিগুণ শুল্ক দিতে হয়। সাম্প্রতি এফবিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১১০ টাকা কেজি দরে আমদানি করা খেজুরে শুল্ক দিতে হয় ১৪০ টাকা। পরে এটি বাজারে বিক্রি হয় ২৫০ টাকায়। একইভাবে ১২০ টাকা কেজির খেজুরে ২১০ টাকা শুল্ক দিয়ে বাজারে ৩৩০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। এজন্যই বাজারে খেজুরের দাম এত বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গত বছর এক কেজি খেজুরে মাত্র ১০ টাকা শুল্ক দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, ইফতারের সময় মুসলমানরা অন্তত দুই-তিন টুকরো খেজুর খেয়ে থাকেন। গত ৩৫ বছর ধরে আমি খেজুর আমদানি করি, কিন্তু কখনও শুল্ক দিতে হয়নি। আমি খেজুর আমদানি করলাম ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারে। চট্টগ্রামের কাস্টম কমিশনার সাধারণ কনটেইনার খেজুরের জন্য ২৫০০ ডলার এবং হিমায়িত কনটেইনারে খেজুরের জন্য ৪০০০ ডলার শুল্ক নির্ধারণ করেছে। এতে খেজুরের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। আমরা এনবিআর-এ কথা বলেছি, তারা কোনো যুক্তি দেখাতে পারল না কেন এটার শুল্ক ২৫০০/৪০০০ করল। এই অ্যাসেসমেন্টে এক কার্টন খেজুর আমাকে বিক্রি করতে হবে সাড়ে ৪০০০ টাকায়, কেজি পড়বে ৪৫০ টাকা। আসলে আমরা সবাই যদি সহযোগিতা না করি, তাহলে বাজারে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম রাখতে পারব না।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্রগ্রামের ফলমন্ডির খেজুর মার্কেটে পাইকারি এ বাজারে জাহেদি, সাইয়িদি, ফরিদি, সাফায়ি, রশিদি, মাশরুখ, মাবরুর, নাগাল, কুদরি, আজওয়া, মেদজুল, মরিয়ম, দাব্বাস, সুক্কারিসহ নানান জাতের ও নামের খেজুর রয়েছে। একই খেজুর ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডেও রঙিন প্যাকেটে বাজারজাত হয়ে আসছে। ফলমন্ডির ব্যবসায়ীরা বলছেন, সৌদি, ইরান, মিশর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, দুবাই থেকে বেশিরভাগ খেজুর আসে। সৌদি, ইরান, মিশরের খেজুর মানসম্মত হয়। এসব খেজুরের দামও বেশি। বাজারে মধ্যম মানের খেজুর আসে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে।

ফলমন্ডিতে ইজেড নাগাল ব্র্যান্ডের খেজুর পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ২৫০ টাকায়, আলজেরিয়ান ডেটলাইন নাগাল ১০ কেজির প্যাকেট তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ২৫০ টাকা, তিউনিসিয়ান টেটকো ফরিদি পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ২৫০ টাকা। সৌদিয়ান মাশরুখ বিনা ব্র্যান্ডের পাঁচ কেজির খেজুর বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৬০০ টাকা। মাশরুখ-বি ব্র্যান্ডের পাঁচ কেজির খেজুর বিক্রি হয়েছে আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার ৫৫০ টাকায়। মাশরুখ ভিআইপি বিক্রি হয়েছে পাঁচ কেজি দুই হাজার ৬৫০ টাকায়। অপরদিকে দেশের বাজারে যখন অস্থির খেজুরের বাজার তখন পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) খেজুরের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে আরব আমিরাতে প্রায় ৪০ শতাংশ ছাড়ে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং সৌদি আরবের মাজদুল খেজুর প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে ২০ দিরহামে। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রতি কেজি এই খেজুরের দাম ছিল ৩০ দিরহাম। একইভাবে, রুটাব খেজুর সাধারণত ৬০ দিরহামে ৩ কেজি কিনতে পাওয়া গেলেও এখন রমযানের আগে ওই একই পরিমাণ খেজুরের দাম কমে ৪৫ দিরহামে নেমে এসেছে।

https://www.dailysangram.info/post/550722