৬ মার্চ ২০২৪, বুধবার, ৭:৪৭

বাস কোম্পানির ৮০ শতাংশের মালিক ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি

- সরকারের চেয়ে ক্ষমতাধর মালিক-শ্রমিক সংগঠন
- বিআরটিএকে বছরে ঘুষ দিতে হয় ৯০০ কোটি টাকার বেশি

বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। যার ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দল ও বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের। ফলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাত্রীবান্ধব গণপরিহন হয়ে উঠছে না। বাস্তবে তা জিম্মি হয়ে গেছে এসব মালিক শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে। আর এই জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, বছরে প্রায় এক হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসেবে দিতে বাধ্য হন বাস মালিক ও কর্মী বা শ্রমিকরা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হয় বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত।

রাজধানীর মাইডাস ভবনের দফতরে গতকাল ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান, মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ এসোসিয়েট মুহা: নূরুজ্জামান ফরহাদ।

টিআইবির গবেষণার তথ্য বলছে, রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও ‘টোকেন বাণিজ্যে’র জন্য বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকরা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হলো নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ ও হালনাগাদ বাবদ ঘুষ। বাস মালিক-শ্রমিকদের বিআরটিএকে বছরে ঘুষ দিতে হয় ৯০০ কোটি টাকার বেশি। টিআইবি গবেষণার তথ্য বলছে, এই খাতের জিম্মিদশা এতটাই প্রকট যে মালিক-শ্রমিকের আঁতাতের কারণে তাদের আচরণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হিসেবে মনে হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার তার নিজের প্রণীত আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রত্যাশিত সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সাথে এ খাতের সাধারণ শ্রমিকরাও তাদের মৌলিক অধিকারসহ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গবেষণায় দেখা যায়, বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। মালিক সংগঠনের নেতাদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২টি (১৩.১ শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১.৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে এবং এ সব বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (৮০ শতাংশ) এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের (১২ শতাংশ) প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ত করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছেন।

জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৯ শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২৪ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই এবং ২২ শতাংশ বলেছেন বাসের রুট পারমিট নেই। তা ছাড়া, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসে পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সধারী চালকের সঙ্কট আছে। ১১.৯ শতাংশ বাস মালিক জানান তাদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক পেশাদার লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক আছে। জরিপের ২২.২ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের তথ্যানুযায়ী মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান এবং কন্ডাক্টর/হেলপার/সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া চলন্ত বাসে চালকরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ফলে অনেক সময় প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

সিটি সার্ভিসের কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৪ শতাংশ বলেছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। বাস পরিবহন ব্যবস্থায় আরেক উদ্বেগজনক চিত্র হলো হিসাবে উঠে এসেছে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৫.২ শতাংশ নারী বাসযাত্রী যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন। এ হার আন্তঃজেলা (দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক) বাসের ক্ষেত্রে ৩১.৩ শতাংশ এবং সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে ৪২.৬ শতাংশ। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে ৮৩.২ শতাংশ সহযাত্রী এবং ৬৪.৩ শতাংশ হেলপার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে থাকা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত।

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাস পরিবহন ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এসব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে। বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/819175