৫ মার্চ ২০২৪, মঙ্গলবার, ২:৫৪

নারীবাদ পাশ্চাত্যের ন্যায় প্রাচ্যকেও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেবে

-ড. মো. নূরুল আমিন

দেশে ধর্ষণ ব্যভিচারের সীমাহীন ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গামী মেয়েদের অভিভাবকরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তখন একজন নারীবাদী নেত্রী এর নিন্দা ও শাস্তি অথবা পৌনঃপুনিকতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দাবির পরিবর্তে এর জন্য প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন যে যত দিন পর্যন্ত সমাজ ও পরিবারে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থাকবে ততদিন সমাজে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। তার কথাটি পরিষ্কার নয়। সমাজ ও পরিবারে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব না থাকলে মানুষের নৈতিক চরিত্র কিভাবে উন্নত হবে এবং ধর্ষণ-ব্যভিচার হ্রাস পাবে সে বিষয়টি খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। প্রাচ্যের সমাজে তার কোন নজির নেই। পাশ্চাত্যের সমাজে মেয়েরা এত বেশি স্বাধীন যে পরিবারই সেখানে ভেঙে গেছে কিন্তু ধর্ষণ-ব্যভিচার সেখানে বন্ধ হয়নি। পারিবারিক বা সামাজিক শান্তিও নেই। তাহলে?

সম্প্রতি লা মন্ডে পত্রিকায় একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে। জার্মানীর মেয়েরা সন্তানের মা হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ফার্টিলিটি রেট যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনি জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। জনসংখ্যার কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে। বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কর্মক্ষম যুববয়সী লোকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তাদের জাতীয় জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও পেনশান সুবিধা প্রদানের জন্য উপার্জনের ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন যুব জনশক্তি তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারছে না। দেশটির জন্য এটি একটি বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আসলে শুধু জার্মানী নয় পাশ্চাত্যের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে এই সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেখানে পরিবার যেমনি নেই, পারিবারিক বন্ধন এমনকি নিরাপত্তাও নেই। মহিলারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। মা হয়ে তারা কি করবেন? বিয়ে টিকছে না ভেঙে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যত কি? আবার সন্তান হলে ডেটিং করা যায় না, কাজেই তারা সন্তান চাইবেই বা কেন? পাশ্চাত্যের এই ঢেউ প্রাচ্যে এসেও আঘাত হানতে শুরু করেছে। জাতিসংঘ পরিবেশিত এক হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ সালে ইউরোপের জনসংখ্যা ছিল ৭২ কোটি ৭৩ লাখ চার হাজার। এই সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ৭০ কোটি ৭৫ লাখ ৬ হাজার এবং ২০২০ সালে ৬৯ কোটি ৪৮ লাখ ৭৭ হাজারে নেমে এসেছে। সংস্থাটির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫ সালে ইউরোপের জনসংখ্যার ১৩.৮ শতাংশ ছিল ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী এবং ২০২০ সালের মধ্যে এই বয়সী লোকের সংখ্যা ১০.২ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার এর মধ্যে ষাটোর্ধ বয়সী তথা বৃদ্ধদের সংখ্যাও ২০.৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬.৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এই দেশের ১৫ থেকে ২৪ বয়সী লোকের সংখ্যা একই সময়ে ১৩.৫ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে। তবে তারা বিদেশীদের নাগরিকত্ব দিয়ে এই হারটিকে ১২.৬ শতাংশে রেখে ডুবন্ত অবস্থায় নাকটাকে ভাসিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। তবে সেখানেও বৃৃদ্ধ বৃদ্ধার সংখ্যা ১৫/২০ বছরের ১৬.২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ শতাংশে উন্নীত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। এই দিকে প্রাচ্যের উন্নত দেশ জাপানের অবস্থাও প্রায় একই রকম। বলাবাহুল্য এক সময় জাপানে এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিয়ের পর মেয়েদের চাকরি ছিল নিষিদ্ধ; নব্বই এর দশকে এসে তা খুলে দেয়া হয় এবং এর ফলে সেখানকার মেয়েদের মধ্যে সন্তান ধারণ ও লালন পালনে অনীহা দেখা দেয়। তাদের i fertility rate হ্রাস পায় এবং জনসংখ্যার ভারসাম্যে সমস্যা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী জাপানে নব্বই বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী লোকের সংখ্যা ১০ লাখ, এর মধ্যে শতায়ু ব্যক্তি আছেন ২৩ হাজার। একটি ডেমোগ্রাফিক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে যে জাপানে জন্মহার স্বল্পতা দেখা দেয়ায় বয়স্ক লোকেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলী মোকাবেলা করার জন্য জাপানী জনগণকে অবশ্যই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষমতাকেও ধরে রাখতে হবে। অবশ্য এই রিপোর্টে অতিবৃদ্ধ ব্যক্তিরা কিভাবে এই ক্ষমতা ধরে রাখবেন সে সম্পর্কে কিছু বলেনি। কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকটা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বয়স্ক ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে। করভিত্তিক আয় ক্রমশ: হ্রাস পাওয়ায় সরকারের পক্ষে বয়স্ক লোকদের পেনশান ও বয়স্ক ভাতা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবার প্রথা ভেঙে যাওয়ায় সন্তান সন্ততিরা বৃদ্ধ পিতা-মাতার খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় বয়স্ক প্রবীণ লোকেরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক একজন চেয়ারম্যান মি. পিটার পিটার্সন এই ব্যাপারে একটি চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে ২০৩০ সাল নাগাদ বয়স্ক ব্যক্তিদের পেনশন ও অবসর সুবিধাদি দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার জিডিপির ১৭ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। ১৯৯৫ সালে এ খাতে ব্যয় হতো ১০.৫ শতাংশ। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থা ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায়ই ভাল। ইতালীতে যে হারে জন্মহার হ্রাস ও বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের বয়স্ক ভাতা জিডিপির ৩৩.৩ শতাংশে উন্নীত হবে। বর্তমানে এর পরিমাণ হচ্ছে ২৫.৭ শতাংশ।

শুধু জার্মানীর মেয়েরাই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশে^র অধিকাংশ দেশের মেয়েরাই এখন মা হতে চান না। পারিবারিক বন্ধন কাকে বলে তা তাদের অজানা। স্বামী-স্ত্রীর সুখের সংসার কি তা তারা জানেন না, অবস্থার এত অবনতি হয়েছে যে এখন এসব দেশে মানুষ আর মানুষের উপর আস্থা রাখতে পারছে না, ইতর প্রাণী তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। শুধু সফরসঙ্গী নয়, শয়নসঙ্গী হিসেবে তাদের একটি বিরাট অংশ কুকুর বিড়ালকে বেছে নিচ্ছে। কিছুকাল আগে বিজরেট রিসার্চ নামক একটি গবেষণা সংস্থা তাদের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৬% মহিলা তাদের স্বামী বা বয়ফ্রেন্ডদের তুলনায় কুকুর বিড়ালকে বেশি ভালবাসেন।

পুরুষদের বেলায় এ সংখ্যা হচ্ছে ৪১ শতাংশ। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা, ব্যভিচার ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক জীবনে হিংস্রতার আধিক্য, ভোগবাদের প্রসার, স্বাধীনতার নামে পারিবারিক শৃঙ্খলার প্রতি উপেক্ষা এবং ধর্মহীনতা প্রভৃতি এর জন্য প্রধানত দায়ী। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে এই যে, যে দেশের পুরুষ ও নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতর প্রাণীকে বন্ধু ও সাথী হিসেবে বেছে নেয় সেই দেশের মানুষই আমাদেরকে নারী মুক্তি ও নারী স্বাধীনতা শিক্ষা দিতে আসে।

পাশ্চাত্য বিশ্বে বিগত শতাব্দিতেই পরিবার প্রথার পরিবর্তন ও অবস্থান্তর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটেছে। Howard Centre for family, Religion and Society এর প্রেসিডেন্ট এলেন কার্লসনের মতে, ‘All the indicators of family wellbeing abruptly turned in these places (Western nations) during the short 1962-65 period. Fertility resumed its fall, tumbling well below zero growth levels, a massive retreat from marriage commenced and Western societies seemed to lose all sense of inherited family order.’

অর্থাৎ ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই সংক্ষিপ্ত মেয়াদে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে হঠাৎ করে পারিবারিক কল্যাণের সমস্ত লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল, মেয়েদের গর্ভধারণের হার হ্রাস পেল, কোথাও কোথাও তা শূন্য প্রবৃদ্ধিরও নিচে নেমে এলো। বিয়ে-সাদী থেকে পিছু হটা ব্যাপক আকার ধারণ করলো এবং এটা প্রতীয়মাণ হলো যে, পাশ্চাত্য সমাজ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাদের সকল প্রকার পারিবারিক চেতনা ও শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলেছে।’

একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, ষাটের দশকে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনলেও জন্মহার হ্রাসের জন্য প্রাথমিকভাবে যে কারণটি দায়ী তা হচ্ছে লিঙ্গ সচেতনতার নামে নারী জাগরণের জোয়ার। পাশ্চাত্যের নারী জাগরণের থিওরি অনুযাী লিঙ্গ অসমতা হচ্ছে পুরুষ শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজে মেয়েদের নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার। কাজেই একে ভাঙতে হবে। নারীবাদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী It was this Patriarchal dominance that forced the woman into the role of mother & wife.

অর্থাৎ পিতৃশাসনই মেয়েদের মা ও স্ত্রীর ভূমিকা গ্রহণে বাধ্য করেছে। কাজেই একে ভাঙতে হবে। এই নারীবাদের কথাই আমাদের নারীবাদী নেত্রীদের মুখে আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি, যা পাশ্চাত্যকে ধ্বংস করেছে।
নারী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেত্রী Belly Frieden এর মতে, ‘When women were denied accessto satisfaction of their needs in the society as a person in her own rights, she made home and the family into a vehicle for her power and control,status and self-realization (which) then became her Frankenstein monster.’

অর্থাৎ ‘যখন ব্যক্তি হিসেবে সমাজে মেয়েদের চাহিদাগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলো তখন তারা নিজ অধিকার বলে তাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, মর্যাদা ও নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরিবার ও বাড়িকে বাহনে পরিণত করলো যা পরে তাদের জন্য ফ্রাঙ্কেন্সটাইন দানবে পরিণত হয়।’ এই দানবটিকে তারা সাধারণ নাম দিয়েছে বিবাহ। নারীবাদের আধ্যাত্মিক নেত্রী জার্মেয়েইন গ্রীয়ার ও গ্লোরিয়া স্টিনেম এই দানবটি তথা বিবাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তাদের ধারণা, একমাত্র বিবাহ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারলেই পুরুষ শাসন ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মেয়েদের রক্ষা করা সম্ভবপর।

বিবাহ প্রথা বিলোপের ধারণা নারী স্বাধীনতাকামীদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এতই অপরিহার্য ছিল যে, ১৯৭১ সালের বহুল প্রচারিত নারী মুক্তি ঘোষণায় তারা তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী, , ‘The end of the institution of marriage is a necessary condition for the liberation of women’ বিবাহ প্রথার বিলোপসাধনই হচ্ছে নারী মুক্তির অপরিহার্য শর্ত। নারী মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র Ms. Magazine এর সম্পাদক রবিন মর্গান ‘Sisterhood is powerful’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেছেন যে, বিবাহ প্রথাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমরা নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে পারি না। অনেক নারীবাদী বিবাহকে দাস প্রথার সাথে তুলনা করেছেন। মার্কিন নারীমুক্তি সংস্থা NOW-এর প্রধান শিলা ক্রোনিনের মতে, যেহেতু বিবাহ নারীকে দাসীতে রূপান্তরিত করে, সেহেতু সকল নারী আন্দোলনের মূল কাজ হচ্ছে এই প্রথাকে ধ্বংস করা। অনেক নারী নেত্রী বিবাহের তুলনায় মেয়েদের জন্য বেশ্যাবৃত্তিকে উত্তম বলে মনে করেন। কেউ কেউ আবার এই দু’য়ের মধ্যে কোনও তফাৎ দেখতে পান না।’ ‘Taking our eyes off the Guys’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে সোনিয়াজনসন নামক একজন মার্কিন নারী নেত্রী লিখেছেন, , ‘Women have been seasoned as slaves and prostitutes... But no matter how we are seasoned, as prostitute or as wife, which is the same thing- We’re seasoned in the patriarchal family almost exclusively to serve sexual functions.’ অর্থাৎ দাসী এবং বেশ্যা হিসাবেই মেয়েরা বড় হয়ে আসছে। কিন্তু কিভাবে আমরা পূর্ণতা পেলাম, বেশ্যা হিসেবে অথবা বধূ, যা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ; এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, পুরুষ শাসিত পরিবারে আমরা বড় হই এককভাবে যৌন চাহিদা পূরণের জন্য।’

পাশ্চাত্যের এই নারী নেত্রীর মন্তব্য জঘন্য মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
এন্ডি ডরকিনের ন্যায় কোন কোন নারীনেত্রী বিবাহের সাথে ধর্ষণের কোনও তফাৎ খুঁজে পান না। তাদের মতে, ধর্ষণের পরিশীলিত রূপ হচ্ছে বিবাহ। তাদের এই মতবাদটি আরো ভয়াবহ। তাদের ভাষায়, Rape, originally defined as abduction, became marriage by capture. আবার rape হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী বন্দিত্ব, বিয়ে চিরস্থায়ী দাসত্ব এবং মালিকানা হস্তান্তর। কাজেই বিয়েকে তারা ধর্ষণ থেকে বেশি মারাত্মক মনে করে এবং তার উৎখাতকে নারী জাগরণ ও স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বলে বিশ্বাস করে। নারী জাগরণের আরেক প্রবক্তা লি-া গর্ডন মনে করেন যে, পরিবার প্রথাকে অবশ্যই ভাঙতে হবে এবং মানুষকে একত্রে বসবাসের জন্য উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। যেখানে দায়দায়িত্বের বালাই থাকবে না। ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়দায়িত্ব পালনের কারণে মেয়েদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। পরিবারের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য গৃহের বাইরে মেয়েদের সার্বক্ষণিক কর্মসংস্থান প্রয়োজন। এই প্রয়োজনকে সামনে রেখে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মেয়েদের ঘরের বাইরে আনা হয়েছে। ’৭০, ৮০ ও ৯০-এর দশকে নারীবাদীরা তাদের দাবির অনুকূলে রাষ্ট্রীয় নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। অনেক দেশে যখন তখন তালাক দেয়ার আইন পাস হয়েছে। সিঙ্গেল প্যারেন্ট আইডিয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছে, জারজ সন্তান হওয়া সমাজের জন্য এখন কোন বোঝা নয়। বিবাহ প্রথাকে তারা সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে না পারলেও পাশাপাশি লিভটুগেদার, হোমো সেক্সুয়ালিটি এবং সমলিঙ্গ বিবাহের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন লাভের মাধ্যমে পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি কুঠারাঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক মহিলা বিয়েতে বিশ্বাস করেন না। আবার যারা সন্তান চান, তাদেরও অনেকে সন্তানের জন্য বিয়েকে অপ্রয়োজনীয় শর্ত বলে মনে করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক শুমারী অনুযায়ী ১৯৩২ সালে ঐ দেশে ৮.২ শতাংশ মহিলা বিয়ের আগেই প্রথম সন্তান প্রসব করেছে। ৫৩.৬ শতাংশ মহিলা বিয়ের পূর্বেই গর্ভবতী হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ২০১০ সালে কুমারী মায়ের সংখ্যা ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং গর্ভধারীণী ৩২ শতাংশ মহিলা শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিড়িতে বসেছে।

নারী আন্দোলন পাশ্চাত্যের পরিবার প্রথাকে ভেঙে দিয়েছে। ২০০০ সালে পরিচালিত এক শুমারীতে মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবারের মত উল্লেখ করা হয়েছিল যে ঐ দেশে পিতা-মাতা ও সন্তান নিয়ে গঠিত পরিবারের সংখ্যা এক চতুর্থাংশের নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিকে সন্তানহীন সিঙ্গেল মার্কিনীদের সংখ্যা জনসংখ্যার ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন কাজ। ইউরোপের অনেক দেশে অর্থিকভাবে উৎসাহ প্রদান করেও দম্পতিদের সন্তান গ্রহণে রাজী করানো যাচ্ছে না। তবে এর বিপরীতে চাঞ্চল্যকর ঘটনাও পাশ্চাত্যে ঘটছে। ওয়াশিংটন পোষ্টের (৩০ জুলাই ২০১৫) এক রিপোর্ট অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের এক মহিলা আরেক গর্ভবতী মহিলাকে ফুঁসলিয়ে জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে তার উপর আক্রমণ করে তার পেট কেটে সন্তান চুরির সময় ধরা পড়ে যায়। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অনেক অপরাধের ঘটনা সর্ম্পকে আমরা শুনেছি, কিন্তু পেট কেটে সন্তান চুরির কথা শুনিনি।

মানবেতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল এবং সম্ভবত: এই প্রথম তাও আধুনিক বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ও সভ্যতার প্রধান মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনাটি যতই মর্মান্তিক হোক, আমি এর মধ্যে বঞ্চিত মাতৃত্বের ক্রন্দন শুনতে পাই। ভোগবাদ পাশ্চাত্যের নারী সমাজকে তাদের স্বাভাবিক চরিত্রের বিকাশ থেকে বঞ্চিত করেছে। নারী স্বাধীনতার নামে পুরুষের সমকক্ষ হতে গিয়ে নারীরা হয়েছে পুরুষের দাসী ও বিলাস সামগ্রী। তারা ঘর সংসার এবং মাতৃত্ব হারিয়েছে। পুরুষের অত্যাচার তাদের বিবাহ বিমুখ করে কুকুরকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য করেছে। বিবাহের স্থান দখল করেছে লিভ টুগেদার ও হোমো সেক্সুয়াল সংস্কৃতি। কিন্তু এতেও তারা শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। মহিলাদের একটা অংশ বিয়ে সংস্কৃতিতে ফিরে আসতে চাচ্ছে। শেষোক্ত গ্রুপের ক্ষীণ প্রয়াস বিলুপ্ত পরিবার প্রথাকে কতটুকু পুনরুদ্ধার করতে পারবে একমাত্র সময়ই তা বলে দিতে পারবে। পাশ্চাত্যের মহিলাদের একটা বিরাট অংশ এখন নিজেরা সন্তান নিতে চান না, অন্যের সন্তানকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করতে চান। এই প্রবণতার বিপরীতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে সেখানে আরেক শ্রেণীর মহিলাদের আবির্ভাব ঘটেছে যারা গর্ভ ভাড়া দিয়ে পয়সা রোজগার করেন। এদের SURROGATED MOTHER বলা হয়। কাজেই এখানে প্রকৃত মাতৃত্ব কোথায়? যেখানে প্রকৃত মাতৃত্ব নেই সেখানে মানব সন্তানতো পশুর বৈশিষ্ট্য নিয়েই বড় হয় এবং এই অবস্থায় সভ্যতা থাকতে পারেনা।

১৯৮৪ সালের হাইকোর্টের একটি রায় ইংল্যান্ডে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই রায়ের ১১ বছর আগে এক ভদ্র মহিলা নিম্ন আদালতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিলেন। মামলায় তিনি এই মর্মে DECLARATORY JUDGEMENT প্রার্থনা করেছিলেন যে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দেয়ার আগে স্বাস্থ্য বিভাগকে তার মায়ের অনুমোদন নিতে হবে। নি¤œ আদালত তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। তিনি হাইকের্টে আপিল করেন। তার ১১ বছর আইনী লড়াই এর পর হাইকোর্ট তার পক্ষে রায় প্রদান করে এবং ডাক্তারদের উপর এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় যে মায়ের অনুমতি ছাড়া তারা ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের CONTRACEPTION দিতে পারবে না। এই রায়ে সারা বৃটেনে হৈ চৈ পড়ে যায়। গার্ডিয়ানের মতো ঐতিহ্যবাহী দৈনিক পত্রিকায় এর উপর সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখে বলা হয় যে, এর ফলে বহু সম্মানিত ব্যক্তি তাদের ইজ্জত হারাবেন। বৃটেনে ভাই-বোন পিতা কন্যাসহ নিকট ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ও অনাচার (incest) এতো বেশি যে তাদের আশংকা এর ফলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে যাবে। আসলে এটাতো শুধু বৃটেনের সমস্যা নয়। সারা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এই সমস্যায় ভুগছে এবং প্রাচ্যেও এর ঢেউ এসে লেগেছে। নৈতিক মূল্যবোধর অবক্ষয়, সম্ভোগ লালসা, চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতা, ধর্মীয় চেতনার বিলুপ্তি এবং আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতার অভাব মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এই ধ্বংস থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তারা যে কোন চেষ্টায় করছেনা তা নয়। সেই চেষ্টা দুর্ভাগ্যবশতঃ যথার্থ নয় ফলপ্রসূও নয়। অবিবাহিতদের গর্ভপাত নিয়ে রাজনীতি এসব দেশে এই প্রচেষ্টারই একটা অংশ। এই রাজনীতিতে কখনো তারা গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করছে আবার কখনো বেআইনী করছে। কিন্তু ব্যভিচার বন্ধে স্থায়ী কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও লস এঞ্জেলস অঙ্গরাজ্যে বহু দিন ধরে বিতর্ক চলছে।

ইকোনমিষ্টের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যালিফোর্নিয়ার ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং সতের বছর বয়সী মেয়েদের তিন পঞ্চমাংশ বিবাহ-পূর্ব সংসর্গে লিপ্ত হয়। সাময়িকীর মতে শুধু ক্যালিফোর্নিয়া নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আরো ৩৪টি অঙ্গরাজ্যে একই সমস্যা। সমগ্র ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং এশিয়া আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও এই রোগে ভুগছে। প্রবাসীদের কল্যাণে সারা দুনিয়ায় এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে।

বহু শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্ব নিজেদের এথেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে অধিকতর শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম ও প্রযুক্তি তাদের হাতে না থাকায় সর্বোপরি শাসক শ্রেণীর অনীহার কারণে তারা আগ্রাসন প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছে। এই অবস্থা মানব সভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলতে উদ্ধত হয়েছে।

ব্যভিচার পাশ্চাত্য সভ্যতার মর্মমূলে যেভাবে আসন গেড়ে বসেছে তা যদি অব্যাহত থাকে তা হলে আগামী দু দশকের মধ্যে তাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ জারজ সন্তানরা দখল করে বসবে এবং এ অবস্থা হবে পাশ্চাত্য সভ্যতার আত্মহত্যার শামিল। সস্তা বা সাময়িক কোন সমাধান নয়, নৈতিক মূল্যবোধর পুনরুদ্ধার এবং পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এর একমাত্র সমাধান। পাশ্চাত্যবাসীদের বুঝতে হবে যে পরিবার না থাকলে সমাজ সভ্যতা টিকতে পারেনা। বিকৃত খৃষ্ট ও ইহুদিবাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছে। ঠান্ডা মাথায় ইসলামকে অধ্যয়ন করে তারা এই জীবন ব্যবস্থা থেকে যত শীঘ্র শিক্ষা গ্রহণ করেন ততই মঙ্গল। ইসলামী মূল্যবোধ, আকিদা বিশ্বাস এবং পারিবারিক শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেললে প্রাচ্য ও অধিকতর দ্রুত গতিতে এই আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের আলেম ওলামা, সমাজবিজ্ঞানী ও শাসক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস আবশ্যক।

https://www.dailysangram.info/post/550408