২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০১

সাইবার নিরাপত্তা আইন

জামিনযোগ্য ধারা বাড়ল, তবে উদ্বেগ রয়েই গেল

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, প্রস্তাবিত আইনে তা প্রায় একই রাখা হয়েছে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশের পর থেকে মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তারা বলছে, কার্যত নাম বদলে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল বিষয়বস্তু সরকার বহাল রাখতে চাইছে। এ নিয়ে আপত্তি ও সমালোচনার মুখে প্রস্তাবিত আইনের আরও দুটি ধারার অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এখন এই আইনে চারটি ধারা অজামিনযোগ্য থাকল। আগের খসড়ায় ছিল ছয়টি।

এই পরিবর্তন এনে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’–এর খসড়া গতকাল সোমবার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। যদিও মূল উদ্বেগ ছিল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেগুলো প্রস্তাবিত আইনেও প্রায় একইভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে নতুন আইনেও অপপ্রয়োগ এবং অপব্যবহারের আশঙ্কার কথা বলে আসছেন সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকে। তাঁদের মূল আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনে কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে ৭ আগস্ট অনেকটা আকস্মিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করার কথা জানায় সরকার। ওই দিনই প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। অবশ্য মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল নয়, পরিবর্তন করা হচ্ছে।
আইনমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের এক দিন পর ৯ আগস্ট তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির’ ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করে সরকার। পাশাপাশি প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে চাইলে ১৪ দিনের মধ্যে মতামত দেওয়া যাবে—এমনটি বলা হয়। পরে জানা যায়, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ শর মতো মতামত এসেছিল। এসব মতামত আইসিটি বিভাগ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আর গতকাল প্রস্তাবিত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হয়। মন্ত্রিসভা এই খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ায় আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার জাতীয় সংসদে সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছিল। শুরু থেকেই এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও এই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে বেশ কয়েকবার আপত্তি তোলা হয়েছিল। দেশ–বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে। যদিও ডিজিটাল আইনের বেশির ভাগ ধারার বিষয়বস্তু অনেকটা অবিকৃতভাবে প্রস্তাবিত আইনে রেখে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তন বলতে জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হলেও এই আইনে করা মামলাগুলোর বিচার নতুন আইনে হবে না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের কথা বলেছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে আগের মতোই বিষয়বস্তু প্রায় একই বহাল রাখা হয়েছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। নতুন আইনেও এটি রয়েছে, বিষয়বস্তুর অস্পষ্টতা দূর করা হয়নি।

যে ধারাগুলো জামিনযোগ্য হলো
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ১৪টি। ধারাগুলো হলো ১৭, ১৯, ২১ ,২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারা। ৭ আগস্ট সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার সময় সেখান থেকে ৮টি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছিল। এগুলো হলো ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারা। আর এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় নতুন করে ২১ এবং ৩০ ধারাও জামিনযোগ্য করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে জামিনযোগ্য ধারাগুলো হলো ১৮ (১) (খ), ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৪৬।

নতুন করে জামিনযোগ্য করা ২১ ধারায় সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা আগের মতোই রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারায় সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
এ ছাড়া ৩০ ধারায় আইনবহির্ভূতভাবে ‘ই-ট্রানজেকশন’ (ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে লেনদেন) সংক্রান্ত অপরাধ ও সাজার কথা বলা আছে।

কী আছে চার অজামিনযোগ্য ধারায়
প্রস্তাবিত আইনে অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ৬টি। এখন দুটি ধারা নতুন করে জামিনযোগ্য করায় অজামিনযোগ্য ধারা রয়েছে চারটি। অজামিনযোগ্য চারটি ধারা হলো ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩। এর মধ্যে ১৭ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশসংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের কথা রয়েছে। ১৯ ধারায় কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন, ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ৩৩ ধারায় হ্যাকিং–সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এই চার ধারা বাদে বাকি সব কটি ধারাই জামিনযোগ্য। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়াটিকে আরও নমনীয় করা হয়েছে।

এর আগে ১০ আগস্ট প্রস্তাবিত আইন নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামিনযোগ্য ধারা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন কারিগরি ধারা ছাড়া খসড়া আইনে আর কোনো ধারা অজামিনযোগ্য নেই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে, শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা হবে অর্থহীন বলে মনে করে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। ৯ আগস্ট এক বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ আরও বলেছিল, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকার যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার এবং এই আইনে যাঁরা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া হোক।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে কেবল মোড়ক পরিবর্তন করা হয়েছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, লোকদেখানো হিসেবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাজানো কমানো হয়েছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত বিষয়গুলো রয়েই গেল। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে কেবল ১৪ দিন সময় দিয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিষয়বস্তু পরিবর্তন হয়নি। ফলে মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশ ও বাক্‌স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আশঙ্কাগুলো থেকে গেল।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/mn2laokmau