২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:১৮

অস্থির পেঁয়াজের বাজার

খুচরায় ২০ টাকা ও পাইকারিতে বেড়েছে ১০ টাকা

ভারতের বর্ধিত শুল্কারোপের পেঁয়াজ দেশে আসার আগেই ব্যবসায়ীরা মূল্য বাড়িয়ে অস্থির করে তুলেছেন বাজার। দুদিনে আমদানি পর্যায়ে ১০ এবং খুচরায় কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত মূল্য বাড়ানো হয়। অতিমুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা কাজটি করেছেন।

স্থলবন্দরগুলোর কাস্টমসের তথ্যমতে, ভারতের রপ্তানি শুল্ক বাড়ানোর কোনো পেঁয়াজ এখন পর্যন্ত দেশে প্রবেশ করেনি। মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনাজপুরে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অপরদিকে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, চীন, জাপান, ইরান, মিসর, তুরস্কসহ যে কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে চাইলে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে। সোমবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা বলেছে, আমরা বিষয়টি বিবেচনা করছি।

প্রসঙ্গত, ১৯ আগস্ট ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে ভারত। অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমবর্ধমান দাম নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যবস্থা হিসাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সংবাদের পরপর বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দামে অস্থিরতা দেখা দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা কেজি। বেনাপোলের আমদানিকারক জান্নাত এন্টারপ্রাইজের মালিক আল মামুন যুগান্তরকে জানান, সবশেষ ভারত থেকে ৩৮-৪৬ টাকায় পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। বর্ধিত শুল্কারোপের পর পেঁয়াজ আমদানি করলে এর মূল্য পড়বে কেজিপ্রতি ৫৩ থেকে ৬৫ টাকা। অথচ পুরোনো আমদানিকৃত পেঁয়াজই বিক্রি হচ্ছে শত টাকা কেজি।

প্রশ্ন উঠেছে বাজার মনিটরিং দুর্বল ব্যবস্থা নিয়েও। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, মনিটরিং দুর্বল না। আসলে খোলাবাজার অর্থনীতি। সেখানে বাজার কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কাজেই ইচ্ছা করলেই বাজার মনিটরিং করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। বিষয়টি নির্ভর করছে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। আমরা কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছি না। আসলে সিন্ডিকেট ভাঙা অনেক কঠিন। তবে পেঁয়াজের সেলফলাইফ বাড়াতে পারলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে সমস্যা থাকবে না।

রাজধানীর পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা, যা দুই দিন আগে ৬০-৬৫ টাকা ছিল। বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬৫ টাকা, যা আগে ছিল ৪৫-৫৫ টাকা।

রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। আর পাড়া-মহল্লার দোকানে ১০০ টাকা। দুই দিন আগেও ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নয়াবাজারের নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. হামিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে। আমরা সবদিকে অসহায়। পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা কীভাবে বাড়ে?

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় দেশে পেঁয়াজের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটু সমস্যা হয়। তাই সংশ্লিষ্টদের আগে থেকেই একটি পরিসংখ্যান রাখা প্রয়োজন।

এই সময় অন্য দেশ থেকে আগেভাগে পেঁয়াজ দেশে আমদানির ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। তা না হলে পণ্যটি নিয়ে অসাধুরা কারসাজি করে। তাই এবার যাতে এমনটা না হয়, এজন্য সংশ্লিষ্টদের এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে আমরা কাজ করব। দাম হঠাৎ করে কেন বাড়ল, এ বিষয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনা করে অনিয়ম আছে কি না, তা দেখা হবে। কোনো অসংগতি পেলে আইনের আওতায় আনা হবে।
পেঁয়াজ পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য-

বেনাপোল পরিস্থিতি : ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এখনো নতুন করে আমদানি শুরু হয়নি। কিন্তু যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোলে দুই দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা।
শুল্ক বাড়ানোর পর শনি ও রোববার কোনো পেঁয়াজ আমদানি করেননি আমদানিকারকরা। বৃহস্পতিবার সাড়ে ৪৬ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে মাত্র ২০২ টন।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, ভারত শুল্ক আরোপের ঘোষণায় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেন। বেনাপোল বন্দরের পরিচালক আব্দুল জলিল জানান, বৃহস্পতিবার এ বন্দর দিয়ে সাড়ে ৪৬ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। এখন যেসব পেঁয়াজ আসবে, তা আগের এলসির। আর চালানগুলো দ্রুত খালাশের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। অতিরিক্ত শুল্ক করারোপের কোনো পেঁয়াজ এখনো আমদানি হয়নি।

হিলি পরিস্থিতি : আগের এলসি করার কারণে বিনা শুল্কে পেঁয়াজগুলো আমদানি হয়েছে। তবুও হিলি স্থলবন্দরের পাইকারি বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি নাসিক জাতের পেঁয়াজ ১৪ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে, যা শুক্রবার বিক্রি হয় ৪৬ থেকে ৪৭ টাকায়। অন্যদিকে ইন্দোর জাতের পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায়, যা সোমবার বিক্রি হয়েছে ৪১ থেকে ৪৩ টাকা দরে। হিলি কাস্টমসের তথ্যমতে, রোববার ভারতীয় ৭টি ট্রাকে ২১১ টন এবং সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৪টি ট্রাকে ১০০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে।

হাকিমপুর (দিনাজপুর) পরিস্থিতি : দিনাজপুরের হিলিতে পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে অভিযান চালিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হাকিমপুর উপজেলার হিলি বাজারে পেঁয়াজের দোকানে পুরোনো মূল্যতালিকা এবং বেশি মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগে এসব জরিমানা করা হয়। দিনাজপুর জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, হিলি বাজারে অভিযান চালিয়ে একটি পেঁয়াজের দোকানে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রির অভিযোগ এবং অপর একটি পেঁয়াজের আড়তে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জনগণের স্বার্থে আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

যশোরে পেঁয়াজের বাজার অস্থির : যশোরে বাজার মনিটরিং না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম হাঁকছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে জেলা প্রশাসকের দাবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তারা বাজার মনিটরিং করছেন। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনের টিম মাঠে নামবে।

রোববার সকাল থেকে কোনো পেঁয়াজবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করেনি। তবে এক সপ্তাহে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৪৭১ টন ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা বিপণন কর্মকর্তা বাজার মনিটরিং করেন। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসন সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/709342