১২ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১২:৫৩

নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

আমি সাত মাসের সন্তান সম্ভবা। ৬ বছরের কন্যা সন্তান এশাকে নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন যাচ্ছে। আমার পরিবারে আর কেউ নেই। গত ২ আগস্ট থেকে আমার স্বামী নিখোঁজ হলেও স্থানীয় পুলিশ আমাকে কোনো সাহায্য করেনি, তাই ঢাকায় এসেছি। গতকাল শুক্রবার এসব কথা বলেন ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার বিনোকদিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ মিয়া (২৬)-এর স্ত্রী কাফিয়া আক্তার শম্পা। তিনি স্বামীর সন্ধানে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। গত ১০ জুন রাজধানীর মুগদা থানার দক্ষিণ মান্ডা এলাকার বাসা থেকে চা খাওয়ার কথা বলে বের হন আব্দুল কাইয়ুম। এরপর আর বাসায় ফেরেননি তিনি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান না পেয়ে অবশেষে মুগদা থানায় জিডি করেন নিখোঁজের স্ত্রী জুড়িয়ানারা বেগম। ঘটনার ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো তার খোঁজ মেলেনি।

সারাদেশের নিখোঁজের কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। নানা কারণে নিখোঁজের জিডি হয়। স্বজনদের কাউকে খুঁজে না পেলেই থানায় জিডি করে নিখোঁজের পরিবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর অনেককেই দিনের পর দিন আদালতে হাজির করা হয় না। এ সময় থানায় জিডি করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন পরিবারের সদস্যরা। তবে প্রতি মাসে শুধু রাজধানীতেই নিখোঁজের জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হচ্ছে ৪৯৮টি। এত নিখোঁজ মানুষ যায় কোথায়, কত জনই বা ফিরে আসে এমন কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। এই নিখোঁজের তালিকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষই আছে।

আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইনকিলাবকে বলেন, নানা কারণেই মানুষ নিখোঁজ হতে পারে। প্রতিটি নিখোঁজের ঘটনাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে পুলিশ কোনো গাফিলতি করে না। তবে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের পর পুলিশ আটক করে রাখে যা স্বীকার করা হয় না। এ সময় নেতা-কর্মীদের পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় ডিজি বা মামলা করতে গেলে পুলিশ আমলে নেয় না বলে অভিযোগ এমন প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এ ধরনের অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়। কোনো ব্যক্তিতে আটকের পর নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই আদালতে হাজির করা হয়। এখানে আইনের ব্যত্যয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সারাদেশেই পুলিশ অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নানা কারণে মানুষ নিখোঁজ হয়। অনেক তরুণ আবার স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে কাউকে তুলে নেয়ার অভিযোগও আছে। অনেকে ফিরে আসে। আবার অনেকের লাশ পাওয়া যায় বেওয়ারিশ হিসেবে। কিন্তু এসবের কোনো তথ্যই কারো কাছে নেই।

রাজধানীর কদমতলী থানার মুরাদপুর এলাকায় বসবাস করতেন মো. মাসুদ মোল্লা (৩৫)। পেশায় রাজমিস্ত্রি মাসুদ গত ১৭ মে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। স্ত্রী নাদিয়া বেগম বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও মাসুদের কোনো সন্ধান পাননি। নিখোঁজের দুইদিন পর নাদিয়া কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ১২২১) করেন। প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও এখনো মাসুদের কোনো খোঁজ পায়নি পুলিশ।

এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ইরান বলেন, নিখোঁজ মাসুদ যে মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করতেন তা এখনো বন্ধ। নিখোঁজের পর থেকে ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি ২৫ বছর বয়সি মাজহারুল ইসলাম। ঘটনার পরদিন মাজহারুলের বাবা মো. আলমগীর মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেন। একইভাবে গত বছরের ৭ জানুয়ারি রাজধানীর শনির আখড়ার বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি মো. নজরুল ইসলাম। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করে তার পরিবার।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিখোঁজের এমন পরিস্থিতি আইনের শাসনের একটি দুর্বলতা। একটা মানুষ উধাও হয়ে গেল, কীভাবে হলো, কেন হলো, তার কোনো গুরুত্ব নেই। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।

ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী নূরুল আমিন ইনকিলাবকে বলেন, নিখোঁজ হওয়ার সংস্কৃতিটা বেশি দিনের নয়। আগে নিখোঁজের এমন অবস্থা ছিল না। এখন বিভিন্ন কারণে নিখোঁজের সংস্কৃতি খুব শক্তিশালী হয়েছে। নিখোঁজের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগও আসছে। অনেক মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে যে এমনটা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত) হয়। তবে এর সঙ্গে অন্য নিখোঁজের ঘটনাও আছে।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে নিখোঁজ ও গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে ১১৯টি। এসব অভিযোগের মধ্যে ১০৮টি নথিভুক্ত করেছে সংস্থাটি। অভিযোগগুলোর মধ্যে নিখোঁজ ২৮ জন ফিরে এসেছে, ৩৪ জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়েছে। বাকি ৫৭ জন এখনো নিখোঁজ। তবে নিখোঁজের অধিকাংশ ঘটনারই কোনো অভিযোগ পায় না মানবাধিকার কমিশন। ২০২১ সালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২১ সালে সারা দেশে ১৬২টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সংস্থাটিতে অভিযোগ এসেছে মাত্র ৮টি। ২০২২ সালে সারা দেশে ১৫৮টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে সংস্থাটিতে অভিযোগ এসেছে হাতে গোনা কয়েকটি।

ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার ডিসি ফারুক হোসেন বলেন, এই (নিখোঁজ ব্যক্তি ফিরে আসা) পরিসংখ্যান করা অসম্ভব, বেশ কঠিন। কারণ কম বয়সি ছেলেমেয়ে যারা প্রেম করে চলে যায়, পরিবার জিডি করে। কিন্তু পরে যখন ফিরে আসে, সব স্বাভাবিক হয় তখন থানায় তা আর জানায় না। অভিমান করে বা নানা কারণে বাড়ি থেকে অনেকে চলে যান, পরে ফিরে আসলে তা জানায় না। এছাড়া রাজধানীতে গৃহকর্মী, গাড়িচালক, নিরাপত্তাকর্মীরা না জানিয়ে চলে গেলে থানায় জিডি হয়। এরপর তারা চলে এলে বা খোঁজ পাওয়া গেলেও অনেকেই সে বিষয়ে পুলিশকে জানায় না। ফলে নিখোঁজ ও তাদের ফিরে আসার বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান করা সম্ভব হয় না।

https://dailyinqilab.com/national/article/594187