২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৭ হাজার কর্মী (জনশক্তি) বিদেশে প্রেরণ হলেও সেই তুলনায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি। এ সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ মাত্র ২.৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্সের ওপর সরকারের দেয়া ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা সত্ত্বেও এই পরিমাণ গত দুই বছর আগে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিক চ্যানেল অর্থাৎ হুন্ডি অপারেটররা উচ্চ বিনিময় হার প্রদান করে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করায় মূল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানোর ফলে সামগ্রিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ কম আসার প্রভাব থাকতে পারে। পরিস্থিতি এখন উদ্বেগজনক; কারণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি গত ১৬ মাস ধরে টাকার মানও কমছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বর্তমান নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হারে ডলার কেনার অনুমতি দেয়া। বর্তমানে প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা পর্যন্ত দেয়ার অনুমতি রয়েছে ব্যাংকগুলোর, যেখানে হুন্ডি অপারেটররা ডলারপ্রতি ১১৫ টাকা করে প্রদান করছেন। এরফলে অনানুষ্ঠানিক হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাঠানোর দিকে বেশি ঝুঁকছেন প্রবাসীরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ ৩৭ হাজার লাখ জনশক্তি বিদেশে গেছে। এ সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি এবং আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, যদি প্রতি বছর কমপক্ষে ১৫ লাখ লোক পাঠাতে পারতাম তাহলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব হতো। আর যদি অভিবাসন প্রত্যাশীদের কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি শিখিয়ে পাঠাতে পারতাম তাহলে রেমিট্যান্স এখনকার চেয়ে আরও বাড়তো।
জানা গেছে, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে লকডাউন ও বিধি-নিষেধের কারণে অভিবাসন থমকে গিয়েছিল একেবারেই। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ২০২১ অর্থবছরে ২.৮০ লাখে নেমে আসে।
এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শ্রম অভিবাসন। এরপর থেকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে। এরপর ধাক্কা কাটিয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯.৮৮ লাখ কর্মী বিদেশে যায়।
নিয়োগকারীরা বলছেন, মূলত মহামারির কারণে দুই বছর ধরে যেসব অভিবাসন প্রত্যাশীর বিদেশে যাওয়া আটকে ছিল, তারা ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যাওয়ার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছেন। দীর্ঘ তিন বছর পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য তাদের শ্রমবাজার খুলে দেয়ার পর গত বছরের আগস্ট থেকে প্রায় ২.২৮ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেছেন।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির যুগ্ম সম্পাদক মো. টিপু সুলতান বলেন, সৌদি আরবে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক বেতন পান ৮০০-১,০০০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৩ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা), যেখানে মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতন ১ হাজার ৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৫ হাজার টাকা।
যদিও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবই বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় গন্তব্য দেশ হিসেবে পরিচিত; গত অর্থবছরে ৪.৫২ লাখ বাংলাদেশি কর্মী সৌদি আরব গেছেন। আর এরপরেই রয়েছে মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং কুয়েতের অবস্থান। সৌদি আরবের সকল ফার্মে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করায় জনশক্তি রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে এই দেশের সামগ্রিক অবদান বেশি। সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে মোট বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসনের ৪০ শতাংশই হয়েছে সৌদিতে।
জুনের শেষ সপ্তাহে সংসদে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছিলেন, জনশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন দেশের সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে লিবিয়া, মাল্টা, আলবেনিয়া, রোমানিয়া ও সার্বিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে অন্যান্য দেশে ভ্রমণকারী দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। ২০২১ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রম অভিবাসনের ২১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ১৭.৭৬ শতাংশে নেমে আসে। যদিও স্বল্পদক্ষ কর্মীদের সংখ্যায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০২২ সালে দেশের মোট শ্রম অভিবাসনে স্বল্পদক্ষ কর্মী ছিল ৩.২৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩.২৮ শতাংশ।