৬ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:০৪

নন-ব্যাংক ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৫০-৯৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: ৩৫টির মধ্যে ৪টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি সহনীয় মাত্রায়

দেশের ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৩ থেকে ১০ শতাংশ। ১০ থেকে ২০ শতাংশ আছে ১৫টিতে এবং ২০ থেকে ৫০ শতাংশ খেলাপি ৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। তবে ৯টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ সহনীয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসাবে মাত্র ৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে সবচেয়ে বেশি খেলাপি পিপলস লিজিংয়ের। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ৯৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরপরই বিআইএফসি, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ৯৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তৃতীয় ফারইস্ট ফাইন্যান্স। এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ৯৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ৯০ দশমিক ৪০ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, ফাস্ট ফাইন্যান্সের ৮৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৫২ দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এ ৯টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত খেলাপি ঋণের অঙ্ক ১১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। খেলাপিসহ ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। এ টাকা থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। বেড়ে গেছে অকার্যকর ঋণ। এতে একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ব্যয়। খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ঋণ জালিয়াতি। মূলত ৯টি নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এটি এযাৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খাতটিতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেড়েছে ৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। তবে এর তিন মাস আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এ অঙ্ক ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে দুই খাতেই খেলাপি কিছুটা কমেছে। আর এটি কমাতে বিপুল ঋণ পুনঃতফসিল, অবলোপন ও সুদ মওকুফ করেছিল প্রতিষ্ঠানগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি-জালিয়াতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা। এসব প্রতিষ্ঠান আমানত ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছে। ঋণ গ্রহীতারাও চাহিদামতো ঋণ বা লিজ না পেয়ে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে সব মিলে অর্থনীতিতে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবদান কমে যাচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত।

অন্যদিকে এ খাতের ৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ১৭১ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো খাতের সমন্বিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৩ কোটি টাকা।

জানা গেছে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চলে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এর মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছে। বাকিদের অবস্থা নড়বড়ে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি অর্থনীতির এক দুষ্ট ক্ষত। এ ঋণের বড় অংশই ইচ্ছাকৃত। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের টাকা আদায়ে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও জালিয়াতি রোধ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি।

ব্যাংক খাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসছে। যে নীতিমালাগুলো দিচ্ছে সেগুলো ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। তারা মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় তো পাবই। এছাড়া ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হয় না।
তিনি আরও বলেন, হঠাৎ হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ বা নীতি হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যাংকের জন্য মঙ্গলজনক। যাতে করে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা জরুরি। এর আগেও খেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে ব্যাংকিং কমিশনের মাধ্যমে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/682812