২৫ মে ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৬

মৌলবাদ জঙ্গীবাদ ও ইসলাম

-ড. মো. নূরুল আমিন

॥ গতকালের পর ॥
আর যদি কেউ কাউকে জীবন দান করে তবে সে যেনো সমস্ত মানুষকে জীবন দান করলো। একইভাবে সূরা নিসা: ৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হন। অভিসম্পাত করেন এবং তার জন্যে ভয়ংকর আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।” তিরমিজি শরীফের হাদিসে আছে, ‘হত্যাকারীর ফরজ-নফল কোনো এবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।” বোখারী শরীফের আরেকটি হাদিসে আছে, “রাসূল তা. বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষ হত্যার বিচার হবে।” তিরমিজি শরীফের আরেকটি হাদিসে আছে, “রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, একজন মুসলমান হত্যা করা অপেক্ষা আল্লাহর দরবারে সমগ্র দুনিয়া ধ্বংস করা সমধিক সহজ।” মুসলিম শরীফের অরেকটি হাদিসে আছে ‘রাসূল সা. বলেছেন, সাতটি জিনিস মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে, তার মধ্যে দু’টি হচ্ছে যথাক্রমে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা এবং কাউকে হত্যা করা। মুসলমানরা যদি হত্যার রাজনীতি করতেন তাহলে ভারতবর্ষে তাদের আটশত বছরের শাসনে কোনো অমুসলমান বেঁচে থাকতে পারতো না।

প্রায় বছরখানেক আগে ছাত্রজীবনে আমার সহপাঠী বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একজন নেতা আমাকে কয়েকটি পুস্তিকা নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়তে বললেন এবং কথা প্রসঙ্গে এটা বলতেও ভুলবেন না যে কুরআনের অনুসারীরা মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে পারে না (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি যে পুস্তিকাগুলো আমাকে দিয়েছিলেন সেগুলো ছিলো মুখ্যত শ্রীরাম জন্মভূমির উপর লেখা এবং মুসলিম শাসকদের বর্বরতার বিবরণী। পুস্তিকাগুলো আমি পড়লাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কিভাবে দুনিয়ার বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য পবিত্র কুরআনের আয়াতের কদর্থ করে তারা দেশে দেশে ছড়াচ্ছে এবং আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এ কাজকে নিজেদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। পাঠকদের অবগতির জন্য আমি এখানে সামান্য নমুনা তুলে ধরছি। এই পুস্তিকায় সূরা বাকারার ১৯৩ নং আয়াতের উল্লেখ করে তার একটি তরজমা দেয়া হয়েছে। এই আয়াতটি হচ্ছে ওয়া কাতেলু হুম হাত্তা লা তাকুনু ফেতনাতুন অ-ইয়া কুনাদ দ্বীনা লিল্লাহে ফা ইনিনতা হাও ফালা উদওয়ানা ইল্লা আলাজজলেমিন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই আয়াতের তরজমা করেছে, “Fight against them until idolatry is no more and Allahs religion reigns supreme” অথচ এর প্রকৃত তরজমা হবে, “And fight them on until there is no more persecution and the religion becomes Allah’s but if they cease let there be no hostility except to those who practise oppression’ অর্থাৎ আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আমার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়ে যায় তাহলে কারুর প্রতি কোনো জবরদস্তি নেই। শুধু তারা ছাড়া যারা নিপীড়ন অব্যাহত রাখবে। পবিত্র কুরআনে ফেৎনা উৎখাতের কথা বলা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে অত্যাচার, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন প্রভৃতি। হিন্দুরা, মূর্তি পূজা করে এবং মূর্তি তাদের জন্যে প্রিয়। পরধর্মে সহনশীলতার অংশ হিসেবে কুরআন মজিদে মূর্তিকে গালি দিতে পর্যন্ত নিষেধ করা হয়েছে। যদিও ইসলাম মূর্তি পূজার বিরোধী। ইসলাম এও বিশ্বাস করে যে জবরদস্তি করে কারো ধর্ম বিশ্বাস পরিবর্তন করা যায় না। এ অবস্থায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনমতকে বিষিয়ে তোলার জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ফেতনা শব্দটির তরজমা করেছে idolatry তথা মূর্তি পূজা এবং ফেৎনার অবসানকে মূর্তি পূজার উচ্ছেদ। একইভাবে তারা সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াতের কদর্থ করে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে ধার্মিক মুসলমান মানেই হচ্ছে সন্ত্রাসী। আমাদের দেশের মুসলিম নামধারী এক ধরনের রাজনীতিক শক্তির বিরুদ্ধে এটাকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। গত ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় পরিকল্পিত বোমা হামলার তদন্ত পর্যায়ে এর সাথে জামায়াতুল মুজাহেদীন নামক একটি সংস্থার সম্পৃক্ততার প্রমাণ ইসলাম বিরোধী শক্তি, দল ও গণমাধ্যমের প্রচার প্রপাগান্ডাকে আরো শক্তিশালী করেছে। এতে অনেকের চিন্তা চেতনায় বিভ্রান্তি ও ধূম্রজালের সৃষ্টি হচ্ছে।

এখানে দ্ব্যার্থহীনভাবে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া দরকার যে ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ মনোনীত একটি জীবন বিধান যার উৎস কুরআন এবং সুন্নাহ, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের কোনো মিডিয়া নয়। এই ইসলামে মানুষ হত্যার লাইসেন্স কখনো ছিলো না এখনো নেই। বস্তুতঃ মানুষের কল্যাণই হচ্ছে ইসলামের লক্ষ্য। মানুষ হত্যা করে, তার ধন সম্পদ মান মর্যাদা ধ্বংস করে তার কল্যাণ সাধন করা যায় না। এজন্য ইসলামে খুুন, রাহাজানি দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি, ব্যভিচারসহ অপরাধমূলক সকল প্রকার কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের ফৌজদারী আইনে এসব অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, আখেরাতের শাস্তি তো আলাদা। আল্লাহর নবী সা. বিদায় হজের ভাষণে প্রত্যেক মানুষের জান মাল ইজ্জত মুসলমানদের জন্যে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ এবং তার নবী সা. যা হারাম করেছেন কোনো মুসলমান নামধারী তা হালাল করতে পারেন না। যারা করেন তারা বিভ্রান্ত, মুনাফিক, পবিত্র কুরআনে এসব কপটাচারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা তাদের সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। সংস্কারের ছদ্মাবরণে সন্দেহজনক আদর্শ-প্রচার করে তারা ফেতনা ফাসাদ ঘটায়। সূরা বাকারায় ১১-১২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যখন তাদের বলা হয় যে দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা তো ভাল কাজই করে যাচ্ছি, মনে রেখ তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।” আর আমাদের দেশের বোমাবাজীসহ যারা হাঙ্গামা সৃষ্টির সাথে জড়িত তারা ইসলাম নয়, ইসলাম বৈরী শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

উপরোক্ত অবস্থায় মুসলিম জাতির সামনে কয়েকটি করণীয় রয়েছে।

এক. কুরআন ও সুন্নাহর প্রতি অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও সামগ্রিক জীবনে তার প্রতিফলনের আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
দুই. জিহাদ মানে কতল নয় যে বরং শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার সার্বিক প্রচেষ্টা এবং মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রয়াস তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা। যুদ্ধ অর্থে যে জেহাদ তা ঘোষণা করার অধিকার যে কেউ যে সংরক্ষণ করে না সে সম্পর্কেও পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।

তিন. মিডিয়ার অপপ্রচার রোধের জন্যে পরিকল্পিতভাবে লেখক সাংবাদিক কলামিস্ট নাট্যকার প্রভৃতি পেশায় পারদর্শী লোক তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত ও ইসলামীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ। এরপর আসে আলেম, ওলামাসহ ইসলামপন্থিদের ঐক্য। আল্লাহর কোনো নবী বাধা বিপত্তি থেকে রেহাই পাননি। আমরাও পেতে পারিনা এবং এ অবস্থাতেই আমাদের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আমরা যদি সৎপথে থাকি আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে।

আমাদের দেশে বোমা হামলা এবং বোমা হামলা-উত্তর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। একটি সেক্যুলার ও ইসলাম বিরোধী শক্তি এদেশে ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যে এত বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে নিজেদের ভবিষ্যত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তার নেতৃবৃন্দ, এমনকি সাধারণ কর্মীদেরকে সন্ত্রাস এবং অপরাধমূলক কাজ-কর্মের অপবাদ দিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায় এবং জবরদস্তি তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারসমূহ ছিনিয়ে নিতে চায়। দ্বিতীয়ত: সংঘাতময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমিকে বাইরের শক্তির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। ইসলামী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের ধুয়া তুলে এ কাজটি করা সহজতর বলে তাদের বিশ্বাস। এটা করতে পারলে তারা আফগানিস্তানের কারজায়ী হতে পারবেন বলে মনে করেন। এবং জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামী শক্তি যে জড়িত নয় একাধিকবার তা প্রমাণিত হয়েছে। বারী কমিশনসহ অতীতের বোমা হামলার তদন্তের জন্যে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সমূহে দেশি বিদেশি যে অপশক্তিসমূহকে এর জন্যে দায়ী করা হয়েছে তাদের সাথে ইসলাম ও ইসলামী সংগঠনসমূহের দূরতম সম্পর্কও নেই। ১৭ আগস্টের বোমা হামলার প্রেক্ষাপটে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের স্বীকারোক্তি, পরিচয় ও সম্পৃক্তির ধরন থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে তারা বিভ্রান্ত এবং দেশি বিদেশি ইসলাম বিরোধী একটি শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। এখানে ইসলামের এবং প্রকৃত ইসলামী সংগঠন সমূহের কোনো ভূমিকা নেই। ইসলাম বরাবরই মধ্যপন্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছে, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এবং চরমপন্থাকে কখনো সমর্থন করেনি। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। ইসলাম আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনী শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং প্রেরণার উৎস। ইসলাম সম্পর্কে যারা বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে লিপ্ত তারা অবশ্যই ব্যর্থ হবেন। (সমাপ্ত)

https://dailysangram.info/post/525461