১৭ মে ২০২৩, বুধবার, ৩:০১

অপরিকল্পিত ইউটার্নে ভোগান্তি

রাজধানীর সড়কগুলোতে অপরিকল্পিত ইউটার্নে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। প্রতিনিয়তই যানজটে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কর্ম ঘণ্টা। এতে আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সকাল বেলা সাধারণ কর্মজীবীরা তাদের নির্দিষ্ট কাজের জন্য বাসা থেকে বের হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারেন না অফিসে। আবার বাসায় ফেরার পথেও একই অবস্থায় পড়তে হচ্ছে তাদের।

রাজধানীর প্রগতি সরণি তথা কুড়িল-বাড্ডা-রামপুরা-গুলিস্তান রুটটির দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রায় সারাদিনই এ সড়কে যানজট লেগে থাকে। অথচ সামগ্রিক দিক থেকে এ রুটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাজধানী ও এর বাইরে থেকে আসা অসংখ্য মানুষ নানা প্রয়োজনে এ রুটে চলাচল করেন। যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন এ রুট সংশ্লিষ্ট মালিবাগ রেলগেট ও কুড়িল বিশ্ব রোড পর্যন্ত বহু ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। এতে তাদের যেমন সময় নষ্ট হয়, ক্ষতি হয় শরীরের। প্রগতি সরণি রুটটি মাত্র ১১ কিলোমিটারের। লম্বা সড়কটিতে সরাসরি চার রাস্তার মোড় নেই। তবে মালিবাগ রেলগেট ও আবুল হোটেলের সামনে তিন রাস্তার দুটি ট্রাফিক ক্রসিং আছে। পুরো সড়কে রয়েছে আটটি ইউটার্ন ও দুটি ইউলুপ ফ্লাইওভার। এছাড়া হাতিরঝিল, গুলশান-১ এবং গুলশান-২ এলাকায় রয়েছে মোট তিনটি তিনটি সংযোগ সড়ক।

গুরুত্বপূর্ণ এ রুটটিতে জন সাধারণের ভোগান্তি চরমে। কারণ, রামপুরা-কুড়িল রোডে যত্রতত্র বাস থামানো হয়। রাস্তার মাঝে হয় যাত্রী তোলা-নামানোর কাজ। এতে বিপাকে পড়ে অন্যান্য যানবাহনগুলো। দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও ব্যাপক। অতীতেও এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। অতিরিক্ত আয়ের আশায় বাস চালক-হেলপাররা এমন অসঙ্গতি ঘটিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ সবার।

রাজধানীর রামপুরা সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সড়কটিতে চলাচলরত অনাবিল, রাইদা, অছিম, হিমালয়, তুরাগ পরিবহণের বাসগুলো বিভিন্ন জায়গায় থামিয়ে যাত্রী তোলা-নামা করছে। সরকার বাস স্টপেজ নির্ধারণ করে দিলেও এসব পরিবহনের চালক-হেলপাররা তা মানে না। কিছু কিছু জায়গায় এমনভাবে বাস থামানো হয়, সামনের দিকে রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেলেও পেছনের দিকে লেগে যায় দীর্ঘ জট।
গণপরিবহনের এমন অব্যবস্থাপনায় গতি নিয়ন্ত্রণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল পেছনের যানবাহনগুলো। এ সড়কে চলাচলরত ছোট ছোট পরিবহনগুলোর চালকরা জানান, প্রতিদিনই তাদের এ ভোগান্তি পোহাতে হয়। তা ছাড়া বাসগুলো মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে আবার নামিয়ে দেয়। ফলে ফুটপাথ থেকে মাঝ রাস্তায় বাস পর্যন্ত যেতে সাধারণ যাত্রীদের পড়তে হয় দ্রুতগতিতে আসা অন্য যানগুলোর সামনে। এতে তাদের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা দুই পরিবহনের চালকদের প্রতিযোগিতা। এতে দুর্ঘটনার ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি হয়। অতীতে এমন ঘটনা দেখেছে দেশবাসী।

যত্রতত্র যাত্রী তোলা-নামানোর কাজ বহুদিনের। সেটি শুধু মাত্র এ সড়কেই নয়, রাজধানীর সবগুলো সড়কেই কম- বেশি দেখা যায়। এমন অব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা সতর্ক করেন, কোনো কোনো সময় জরিমানা করেন। কিন্তু তাতেও সমাধান নেই। কেননা, চালক-হেলপাররা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তারা ট্রাফিক সদস্যদের পাত্তা দেন না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একছাত্র বলেন, কিছু করার নেই। মাঝ রাস্তা থেকে না উঠলে বাস পাওয়া কষ্টকর। তা ছাড়া আমরা রাস্তার দুদিক দেখেই উঠি। দেশের সড়ক পরিস্থিতি ভালো না। আমাদের আর কিছু করার নেই।

বাড্ডা ইউটার্নের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. আলিউজ্জামান বলেন, আমাদের অল্প সংখ্যক ট্রাফিক ফোর্স দিয়ে এত বড় রাস্তা কন্ট্রোল করা আসলে সম্ভব না। ম্যানপাওয়ার বেশি থাকলে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে সুবিধা হয়। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় রাস্তায় যে অংশে ট্রাফিক পুলিশ থাকে, সেখানে চালকরা সতর্ক হয়ে চলে। কিছুদূর গিয়ে তিনিই আবার আইন ভাঙেন। বিশেষ করে ক্রসিংগুলোয় (ইউটার্ন বা চার রাস্তার মোড়) রাস্তা ব্লক করে যাত্রী ওঠা-নামা করায়। এমনকি জেব্রা ক্রসিংগুলোয় বাস ড্রাইভাররা যাত্রী তোলে আবার নামায়। আমরা যতই মামলা করি বা রেকার দিই না কেন; এসব বাস ড্রাইভারদের স্বভাব ঠিক হয় না।

আলিউজ্জামান আরও বলেন, অনেক সময় দেখা যায় একই কোম্পানির গাড়ি বা একই রুটে অন্য কোম্পানির গাড়ি চালকদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতা হয়। কে কার আগে যাত্রী ওঠাবে। কে কার আগে যাবে, কেউ কাউকে জায়গা দেয় না। এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। যানজটও হয় ব্যাপকভাবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামানের বলেন, ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা। আমাদের সড়কে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলে। ছোট, মাঝারি, বড় ও দ্রুতগতির যান চলে। রাস্তায় আমরা যদি আমাদের স্বাভাবিক গতিকে ধরে রাখতে চাই তাহলে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের যে ক্যাটাগরি, সেটি কমিয়ে আনতে হবে। এগুলো যদি বিদ্যমান থাকে, একসঙ্গে চলে তাহলে কোনোভাবেই অব্যবস্থাপনাগুলো কমবে না।

ঢাকা শহরে আমাদের গণপরিবহনের যে ধরনের পরিবর্তন আসার কথা ছিল, তা আসেনি। আর চালক যারা আছে তাদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এসব চালকের সিংহভাগ অ-বেতনভুক্ত। বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক। এসব চালকদের মধ্যে যে অসম ও অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে; সেটাই মূলত যানজটের প্রধান কারণ হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, একটি আদর্শ নগরীতে এ ধরনের ব্যবস্থা সাধারণত সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সিটি করপোরেশন এর একটা কমিটি থাকবে, যারা প্রতিদিন এই অপারেশন কীভাবে হয় সেটি তদারকি করবে। তবে বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা না থাকায় বাস মালিকদের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই বাসের জন্য একটা ফ্রাঞ্চাইজি করা দরকার। আমাদের নগরে অনেক ইউটার্ন আছে; যা অবৈজ্ঞানিক বা অপরিকল্পিত। এটার কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং নেই। যখনই মনে হয়েছে একটা ইউটার্ন দরকার, দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যানজট কমাতে হলে ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশনের আওতায় একটা ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং উইং তৈরি করতে হবে। সেখানে পর্যাপ্ত ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার দিতে হবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/574852